আর সেই বদলের সঙ্গে সঙ্গে ওর কথার ধরন বদলাচ্ছে, চিন্তার ধারা বদলাচ্ছে।
বারো ঘরের ভাড়াটেদের মধ্যে যখন থেকেছে উঁচুনাকী মলিনা, তখন চিন্তার ধারা ছিল তার শুধু ওদের থেকে বিশিষ্ট হওয়া! ওরা রাতদিন গাধা-খাটুনী খাটে, রাতদিন একবস্ত্রে কাটায়, যে বস্ত্রে চিমটি কাটলে ময়লা ওঠে, অসহ্য হলে সাবান সোডার জলে সেদ্ধ করে নিজেরাই কেচে নেয় ওরা। পুরুষদের জামাটা কাপড়টাই শুধু ধোবার বাড়ির মুখ দেখে।
মলিনার গায়ে সর্বদা ব্লাউস সায়া, আর তাদের গায়ে ময়লার ছোপ ধরতে না ধরতে ধোবার বাড়ি চালান হয়।
সংসারের গাধা-খাটুনী কি মলিনাই খাটত না? কিন্তু নিঃসন্তান জীবনের সুবিধায় অবলীলায় সব করে নিত। তারপর ফিটফাট হয়ে বেড়াত।
চুলে গামছা চেপে চেপে পাতা কাটত মলিনা, রাঙতা দেওয়া টিপ কিনে পরত।
তখন মলিনার কথার ধরন প্রায় ওদের মতোই ছিল। স্বপ্নার মা, দাসগিন্নি, সুখদা।
এখন যেন আর একটা ভাষা এসেছে মলিনার মুখে। মেয়েমানুষদের সঙ্গচ্যুত হয়ে গিয়ে মেয়েলি ধরনের কথাগুলো বুঝি ভুলেই গেছে মলিনা। ভুলে যাচ্ছে আটপৌরে কথা।
কথা বলছে পোশাকী ভাষায়।
সে কথার ভঙ্গিতে রহস্যের ব্যঞ্জনা।
ছুটির দিনে সুধানাথ যদি কোথাও থেকে ঘুরে এসে বলে, আর একবার চা হলে কেমন হয়?
মলিনা বলে, খাওয়ার সঙ্গী চাইলে হবে না, না হলে হবে।
সুধানাথ বলে, অমন চায়ের মুখে ছাই।
মলিনা বলে, এ তো ভারী আবদার! সঙ্গী তা হলে জোটাও?
সুধানাথ গম্ভীরভাবে বলে, ভগবান তো দয়াপরবশ হয়ে দিয়েছেন জুটিয়ে।
মলিনা বলে, ভগবানের বালাই নিয়ে মরি। শ্মশান থেকে একখানা আধপোড়া কাঠ এনে তাকে পুতুল বানিয়ে ধরে দিয়েছেন সঙ্গী বলে।
সুধানাথ বলে, হতভাগার ভাগ্যে সেটুকুও সইলে হয়। দুর্ভাগাদের তো পোড়া শোলমাছও জলে পালায়।
মলিনা ভঙ্গি করে বলে, অধিক দুর্ভাগাদের আবার তাও পালায় না, গলায় কাঁটা বিঁধিয়ে ঝুলে থাকে।
.
হয়তো সুধনাথকে বলে মলিনা, তা তুমি সুষ্ঠু নিরিমিষ খাবে কেন? মাছ আনো বাপু, ঝাল ঝাল করে সর্ষের ঝোল বেঁধে দিই–
সুধানাথ বলে, আমার শর্ত তো জানো?
জানি। তা বলে পাগলের পাগলামী মানতে রাজী নই। মাছ না আনলে রাগারাগি করব।
করো! সেটাই বা মন্দ কি! তবু বোঝা যাবে বাড়িতে দুটো জ্যান্ত প্রাণী আছে।
বেশ তা হলে আগে যেমন করতে, তাই কর। সকালে সাত্ত্বিক আহার, রাত্তিরে রেস্টুরেন্টের মাংস পরোটা!
দায় পড়েছে আমার রাত্তিরে খাই খাই করে দু মাইল ছুটতে।
মলিনা রাগ করে বলে, তার মানে আমাকে চির অপরাধিনী করে রাখা। দেখানো যে, দেখো তোমার জন্যে কত সর্বত্যাগী হয়েছি আমি।
সুধানাথ কিন্তু এতেও রাগ করে না। বলে, বাঃ তোমার তো বুদ্ধিটা খুব প্রখর! ভেতরের রহস্য এতো বুঝে ফেলেছ?
তা হয়তো সুধানাথের কথার বাঁধুনীতে মলিনাও শিখেছে বাঁধুনী।
আর চিন্তাতেও বুঝি সেই নতুনত্বের বাঁধুনী।
এখন আর মলিনা ঘুম থেকে উঠে ভাবে না, আজ কয়লাগুলো সব ভেঙে ফেলব, আজ জড়ো করা জামাকাপড়গুলো সাবানে কেচে ফেলব, আজ কেটে-রাখা ব্লাউসটা সেলাই করে ফেলব। অথবা এ ভাবনাও আসে না তার, ছাপা ছিটের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে, কেটে জানলার দুটো পর্দা বানালে হয়, বাসনওয়ালি এলে জিগ্যেস করতে হবে ছেঁড়া পাঞ্জাবী নেয় কি না।
না, এসব চিন্তা আর নেই এখন মলিনার।
মলিনা এখন ঘুম থেকে উঠে এই ধরনের কথা ভাবে, আজ দুখানা মোচার বড়া করতে হবে, আমার জন্যে মানুষটা নিরিমিষ খেয়ে সারা হচ্ছে।…
মুখ ফুটে সেদিন বলেছিল, ওর মা মরে পর্যন্ত নাকি সরুচাকলি খায়নি, দুটো চাল ডাল ভিজিয়ে রাখতে হবে, আজই করে দেব।
সামান্য দুটো নিরিমিষ রান্না, তাই খেয়েই কত খুশি, যেন বর্তে যাচ্ছে। অথচ তার বিনিময়ে কত দিচ্ছে তার হিসেব করবারও সাহস নেই মলিনার।
শুধুই কি খাওয়া পরা?
শুধুই আশ্রয়? শুধুই কি অর্থসামর্থ্য?
জীবনটা বিকিয়ে দেয়নি?
সমগ্র ভবিষ্যৎ?
মান সম্রম, সমাজ পরিচয়?
আত্মীয়জনের দিকে যায় না আর ও, পুরনো আলাপীদের ছায়া মাড়ায় না, নির্বাসন দণ্ড নিয়ে বসে আছে।
অথচ আমি ওকে অহরহই দিচ্ছি মুখনাড়া, দিচ্ছি ঝঙ্কার। বলছি, আমাকে খাঁচায় পুরে রেখেছ।…আমায় স্বাধীনতার ভাত খেতে দিচ্ছ না।
রাগ করে ও একদিন বলে বসেছিল, ও স্বাধীনতার চিন্তা তো তোমার লোকের বাড়ি রান্না করা? তা বেশ তো মনে কর না তাই করছ। মিটে যাবে বিবেকের দংশন।
তখন মলিনাকে বাধ্য হয়ে হৃভঙ্গি করতে হয়েছে। অলৌকিক একটু হাসতে হয়েছে।
বলতে হয়েছে, আহা তাতে তো মাইনে আছে গো! এ যে বিনি মাইনের খাটুনি।
গরিবের বাড়িতে কাজে ঢুকলে এই দুর্দশাই ঘটে।
বলে নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকেছিল ও মলিনার মুখের দিকে।
.
যদিও মলিনার সেই পাতা কাটা চুল আর পরিপাটি টিপ পরা উজ্জ্বল মুখ আর নেই এখন।
চুল বাঁধার পাট গেছে। একরাশ জট পড়া চুল হাতে জড়িয়ে জড়িয়েই চলছে।
কিন্তু কদাচ কখনও চুলটা জট ছাড়াতে বসে আশীতে দেখতে দেখতে মনে হয় মলিনার মুখটা যেন আজকাল তার থেকে বেশি ভালো দেখাচ্ছে। অন্য ধরনের ভালো।
রাস্তায় ঘাটে যে সব ফ্যাসানি মেয়েদের দেখেছে মলিনা, মলিনার মুখে যেন তাদের ছাপ। তাছাড়া সুধানাথও তো কই বলে না চুলে তেল দাও না কেন? বাঁধো না কেন?
মলিনা তাই চুলে আর তেল দেয় না।