ছিল তো
ছিল মানে? মানে, আর তো খবর নিইনি!
না না, অজিত কাজটা ভালো করনি। এতদিন কিভাবে কাটছে মেয়েটার, কে জানে। তুমি এই করে বেড়াচ্ছো জানলে, খোঁজখবর নিতাম। এখন চল আমার সঙ্গে, কাজকর্ম করবে।
আবার কাজকর্ম!
বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকায় অজিত।
মালিক জোর দিয়ে বলেন, কেন করবে না? মানুষ তো ভুল করেই। এবার নতুন করে–
কর্পূরের মতো উবে যাওয়া অজিত ভট্টচার্য তবে নতুন করে জীবন শুরু করতে আবার দেশে ফেরে।
৬. কিন্তু কোথায় তার সেই জীবন
কিন্তু কোথায় তার সেই জীবন?
মাধব ঘোষের বাসার তিন কুড়ি লোক এই হতভাগ্যকে ঘিরে বসে নিখুঁত নিমর্মতায় জানিয়ে দেয়, নেই সে বস্তু। বুঝিয়ে দেয়, ছিলই না কোনোদিন।
থাকলে কখনও এমন কর্পূরের মতো নিমেষে উবে যায়?
দুটো মাস তর সইল না—সুখদা সখেদে বলে, এতগুলো মানুষের উপরোধ অনুরোধ ঠেলে সবাইয়ের নাকের ওপর দিয়ে ছোঁড়ার হাত ধরে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল!
রেলেকাটা মানুষটার কথা কেউ তুলল না। তারা যে স্পষ্ট দেখে এসেছে অজিতের মড়া, সে কথা বলল না।
অজিতের জন্যে তারা শয়নে স্বপনে পথ চেয়ে বসেছিল সেই কথাই বলল।
অনেকক্ষণ বিহ্বলতার ঘোর ছিল, তারপর–
অজিত ভাবল, আশ্চর্য আমি! সামান্য একটু চোর অপবাদে দেশত্যাগ করেছিলাম, গায়ে ছাই মেখে পথে পথে ঘুরেছিলাম, আর এখন স্ত্রী কুলত্যাগ করেছে শুনেও দিব্যি বসে আছি। এতগুলো লোককে মুখ দেখাচ্ছি। এরা চা দিয়েছিল, তাও খেয়েছি। এরা বলেছে, সে কি কথা, যাবে কোথায়? কেনই বা যাবে? আবার বেথা কর, ঘরসংসার কর, তাও শুনছি বসে বসে।
অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বলল, নগেনবাবু সেখানে গিয়েছিলেন বললেন না?
গিয়েছিলেন তার কি? সে বাসায় কি আর আছে নাকি? যেই জানাজানি হয়ে গেছে, ছেড়ে দিয়ে বেলেঘাটায় না কোথায় চলে গেছে। বলে পর্যন্ত যায়নি। পাড়ার লরি গাড়ির ড্রাইভার গিয়েছিল, বাড়ি উঠনো জিনিস নিয়ে, সেই বুঝি বলেছিল। কিন্তু তার খোঁজ করে আর কি হবে? দাসগিন্নি আক্ষেপের নিশ্বাস ফেলেন, মিথ্যে একটা খুনোখুনির দায়ে পড়া বৈ তো নয়! পুরুষের রক্ত তো গায়ে আছে? তার চেয়ে
কিন্তু অজিত কি খুনোখুনির কথা ভাবছে?
না।
তেমন প্রতিহিংসার তীব্রতা খুঁজে পাচ্ছে না অজিত মনের মধ্যে। সে শুধু একবার দেখতে চায় মলিনাকে দেখতে চায়, কি রকম চেহারা হয়েছে মলিনার।
কি রকম হয়ে যায় হঠাৎ অসতী হয়ে যাওয়া মেয়েমানুষ!
আর সেই অন্যরকম হয়ে যাওয়া মলিনাকে একবার শুধু প্রশ্ন করতে চায়-”মলিনা তুমি এই?…বলতে চায়—”মলিনা, এইটাই কি তুমি? তবে আগের সেই মানুষটা?…যে আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকত? আমার অস্তিত্ব নিয়েই বেঁচে থাকত?
সে কে?
মানিকতলার সেই সরু গলির অন্ধকার একতলার ছোট রান্নাঘরটায় বসে মলিনাও ভাবছিল, সে তবে কে?
মাধব ঘোষের বাসায় দাওয়ায় বসে যে মলিনা রান্নার সরঞ্জাম আর মহিমা নিয়ে বসত, সেই মলিনাই কি আমি?
তবে অজিত ভটচায নামের সেই মানুষটা এসে খেতে না বসলেও কিছু এসে যাচ্ছে না কেন আমার? কেমন মনে হচ্ছে না সব মিথ্যে?
রাজ রোজ নতুন নতুন রান্নায় উৎসাহ আসে কোথা থেকে আমার? আর একটা মায়াবী রাক্ষস যখন উৎসাহের জোয়ার বইয়ে সেই রান্না তারিফ করে খায়, তখন আমার প্রাণটা পুলকে ভরে ওঠে কেন?
কই কিছুতেই তো মায়াবীটাকে আমার ভাই বলে মনে হয় না! বারেবারে কেন অজিত ভট্টচাযের মুখের সঙ্গে মুখটা গুলিয়ে যায় ওর?
তবে কি তরোয়ালের খেলায় হার হবে আমার? কেটে টুকরো হয়ে যাব তার ধারে?
আর ওই ছেলেটা!
সে যে সারারাত জেগে পায়চারি করে, সেকথা টের পাওয়া যায় পাশের ঘর থেকে। আর সকালে এসে সেই না-ঘুমানো ক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটিয়ে সে শুধু বলে, আজ কি রাঁধবে বল? কি আনব?
ওর পয়সা নেই।
এই বাসাটুকু ভাড়া করতে আর দুটো লোকের ভাত যোগাতেই সারা হয়ে যায় ও। তবু ছোটোখাটো ঘর সাজানোর জিনিস এনে জড় করে ও, আনে গেরস্থালীর অদরকারি টুকিটাকি।
বারণ করলে হাসে।
বলে, সংসার জিনিসটা যে কি, তার স্বাদ তো জানিনি কখনও। তাই সাধ হল।
মলিনা হাসি মুখে সেই হাসিমুখটা সহ্য করবে? মলিনা কিছু না দিয়ে শুধু নিয়েই চলবে?
কেন?
অজিত ভটচায নামের সেই ছায়াটার অনুশাসনে?
কিন্তু এই মলিনা তো মাধব ঘোষের বাড়ির সেই মলিনা নয়!
এ তো অন্য আর একজন। এ তো একটা থিয়েটারের অ্যাকট্রেস!
অবিরত অন্যের লেখা পার্ট প্লে করে চলেছে। তাই হঠাৎ একদিন যখন বাড়িওলা মানিক দাসের গিন্নি বেড়াতে আসেন, অথবা সরেজমিনে তদন্ত করতে আসেন বাড়ি কেমন ভাবে রেখেছে, আর দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন, তখন মলিনা অম্লান বদনে বলে, ওই তো, ওই পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিকেই মলাম মাসিমা! বলব কি দুটি মানুষই সমান! চিরটাকাল ওই বাড়ি পরিষ্কারই ধ্যান-জ্ঞান।
যেন দুটি মানুষে চিরটাকাল একসঙ্গে থেকেছে।
দাসগিন্নি সে কথা বুঝতে পারবেন এমন হতে পারে না। তিনি শুধু বলেন, এই রকমই চেয়েছিলাম আমরা। শুধু স্বামী-স্ত্রী, কোনো ঝামেলা নেই।
এই চলছে।
এই অভিনয় উৎরোনো।
তবে আর কি করে বলা যায় সেই মলিনাই এই লীনা?
ছিল মলিনা ভটচায, হতে হয়েছে লীনা মিত্র। নাপিত পুরুত ডেকে বদল নয়। রেজিস্টারি অফিসে গিয়ে বদলও নয়, শুধু শুধু বদল, অভিনয়ের বদল।