ভেবে চিন্তে পাড়াটা বদলায়।
পাগলামীর ভোলটাও বদলায়।
আর সেই গায়ে ছাই মেখে হি হি করে হেসে লোকের মনোরঞ্জন করে না। চেয়ে চিন্তে একটা ধুতি আর শার্ট জোগাড় করেছে, পরে মন্দিরের রাস্তায় আসে, আর কোনো যাত্রী নামলেই কাছে। এগিয়ে গিয়ে বলে, বিলেত থেকে এলেন তো বাবু? দেশটা মন্দ না, কী বলেন? তা আমারও একবার যাওয়া দরকার। পরিবার সেখানে পড়ে আছে, আনতে পারছি না, এরোপ্লেনের ভাড়াটা জোগাড় হচ্ছে না, গোটা পাঁচেক টাকা ছাড়ুন না, বাবু?
অধিকাংশই অবশ্য ব্যঙ্গ হাসি হেসে সরে যায়, কেউ কেউ মজার মজার কথা শোনে জিগ্যেস করে করে।
বলে, তা বউ বুঝি মেম? এরোপ্লেন ছাড়া চড়বে না?
আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। মেমই। বাঙালির মেয়ে হয়েও মেম! বুঝলেন কি না বিলেত গেলে যা হয়, মেম দেখে দেখে মেম বনতে সাধ হয়। আমি চাষাভুসো বামুন, আমার পরিবার হয়ে তুই
ওরা হেসে হেসে বলে, তা তুমিই বা হঠাৎ পরিবার নিয়ে বিলেত গেলে কেন?
কেন?
পাগল চোখ মটকায়, আঙুল মটকায়, লজ্জা লজ্জা মুখে বলে, গেলাম কি আর সাধে? পরিবারের জেদ, বিলেত দেখবে, সাহেব-মেম দেখবে, চুরি-জোচ্চুরি যে করে হোক টাকা জোগাড় কর।
নে শালা তুই মর।-বউয়ের জন্যেই যে তার এত জ্বালা সেই কথাই বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
তারপর হঠাৎ সুর ফেৰ্তা করে বলে, তা যাই বলুন বাবু, দেখবার মতোন দেশ বটে!
লোকে হাসির কথার দাম স্বরূপ দেয় চার আনা আট আনা।
কিন্তু কে জানে কথাগুলো ওর শুধুই বানানো কি না। না কি সাজা পাগলের পাগলামি আসলে অবয়ব নিচ্ছে?
সেদিনও এমনি ধরেছে একজনকে। গড়গড় করে বলে চলেছে, সব দেশ দেখলাম বাবু—চিন, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া। বিলেতের মতন এমন দেশ দেখলাম না। বিশ্বাস না হয়, চলুন।
লোকটা হেসে বলে, তুই বুঝি ঘুরে এসেছিস!
শুধু ঘুরে? পাগল দুহাতের দশটি আঙুল ছড়িয়ে বলে, পাক্কা দশটি বছর কাটিয়ে এসেছি। পরিবার বলল, তুমি এখন যাচ্ছ যাও, আমি আর দুটো দিন থেকে যাই। তা বলব কি বাবু, পয়সার অভাবে পরিবারকে আনা হচ্ছে না।
লোকটা আরও হেসে ওঠে, তা এত দেশ বেড়ালি, পয়সা কে দিল? হঠাৎ সে সব পয়সা গেল কোথায়?
ওই তো, ওই বেড়িয়ে বেড়িয়েই তো বিলেত গেছি, এন্তার চাল ফলাচ্ছি, ষোলো ঘোড়ার গাড়ি ভিন্ন চড়ি না, ফল ফললো! পকেট গড়ের মাঠ! এখন এই দেখুন—ভদ্দরলোকের ছেলে, পায়ে এক জোড়া জুতো নেই।…আর বিলেতের এমন আইন, পায়ে জুতো নেই তো দাও ঠেলে হাজতে।
দিন না বাবু গোটা দশ টাকা—একজোড়া জুতো কিনে ফেলি–
লোকটা হয়তো আরও মজা করত, হঠাৎ বিশ্বনাথের গলি থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় বাঙালি ভদ্রলোক।
পাশের লোককে বললেন—”কি রে যতীন?
যতীন মৃদু হেসে বলে, কিছু না বাবু, এক ব্যাট পাগল। বলে, বিলেত যাবে
কথা শেষ হয় না, হঠাৎ পাগলটা সামনে আঁড়ানো মোটর গাড়িটাকে পাক দিয়ে ডিঙিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু পালাতে পারে না।
পথ আগলানো এক ষাঁড়ের ধাক্কায় ছিটকে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়।
আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আচরণটা পাগলজনোচিতই।
কিন্তু প্রৌঢ় ভদ্রলোক যেন দিশেহারা হয়ে এগিয়ে যান। হাত ধরে তোলেন পাগলকে। এবং পাগলের একরাশ দাড়ি গোঁফ সম্বলিত মুখটার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কে তুই?
পাগল হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে।
মুখ নীচু করে বলে, কেউ নেই। একটা পাগলা-ছাগলা ছেড়ে দিন বাবু।
ভদ্রলোক কিন্তু ছেড়ে দেন না।
বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, তুমি অজিত ভট্চায না?
চেষ্টা করেছিল কিছুক্ষণ।
বলেছিল—”আমি বাবু, সাহেব মানুষ, ভটচাযের খবর জানি না। বলেছিল—”বিলেত যাবার টাকাটা জোগাড় হলেই চলে যাই বাবু—পরিবার সেখানে পড়ে আছে!
কিন্তু বেশিক্ষণ পারেনি।
হাউ হাউ করে কেঁদে পা জড়িয়ে ধরেছিল।
যোগাযোগটা অদ্ভুত।
কাশীতে বেড়াতে এসেছেন, কুন্তল বিলাসের মালিক। যোগেন তাঁর সরকার। যোগেনের গুপ্তচরবৃত্তিতেই মালিক ধরতে পেরেছিলেন ওকে।
মালিক যেন বড়ো বেশি মর্মাহত হয়েছেন।
হয়তো অজিতের এই দুর্দশা দেখে তাঁর মনে হচ্ছে সেদিনের ব্যবহারটা বড়ো বেশি নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। হয়তো মনে হয়েছে, লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়েছিলাম আমি। গরিব লোক, লোভ সামলাতে পারেনি, একবারের দোষ ক্ষমা করা উচিত ছিল। অতগুলো লোকের সামনে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে লোকটার জীবনটাই নষ্ট করে দিলাম।…
আমার ব্যবহারে পাগল হয়ে গেছে লোকটা!
এই মর্মদাহ তাকে পীড়িত করতে থাকে।
আসলে অজিতকে ভালোবাসতেন। আর বাসতেন বলেই বোধ করি অত বেশি রেগেছিলেন তার অবিশ্বাসের কাজে।
জোর করে গাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
আর নাইয়ে, খাইয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, বস্তুত পুরো পাগল নয়। লজ্জায়, ঘেন্নায় পালিয়ে এসে আর পথে পথে ঘুরে ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেছে।
যে জীবনটা নষ্ট হবার জন্যে তিনি নিজেই কিছুটা দায়ী, সে জীবনটাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না তিনি? ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না আর একবার সুযোগ দিতে?
চল আমার সঙ্গে।
বললেন মনিব।
অজিত মাথা হেট করে বলল, এ মুখ আর কলকাতায়–
আরে বাবা, রাগের মাথায় বাপ জ্যাঠা, মাস্টার মনিব অমন কত বলে। সেইটা ধরে, মাথা খারাপ করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হবে? ছি ছি! তোমার স্ত্রী আছে না?