বিনা টিকিটের যাত্রীর ভাগ্যে যে কত লাঞ্ছনা জোটে, সে আর তখন মনে পড়ল না তার। বিনা টিকিটে উঠে পড়ার বাহাদুরীতেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
মনে পড়ল না, চুরির অপবাদে চাকরি হারিয়ে মুখ দেখাতে পারবে না বলে বাড়ি ফেরেনি সে। মনে পড়ল না, একটু আগে মনে মনে কান মলেছিল সে যে, জীবনে আর অসততা করব না বলে।
আপাতত যে মাধববাবুর বাসার কারও সামনে পড়তে হল না এটাই পরম লাভ মনে হল।
ওর না ফেরাটা মলিনার ওপর কি আঘাত হানবে, তা স্পষ্ট খেয়ালে এল না। একবাড়ি লোকের সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলল মলিনাকে।
ভীড়ে ঠেলাঠেলি গাড়িতে একটা কোণে গুঁজে বসে রইল, আর ট্রেন ছাড়তেই বলল, দুর্গা দুর্গা।
কোথায় যাবে জানে না।
টিকিট চেকার যদি না ধরে, তাহলে অনেক দূর পাড়ি দেওয়া যাবে। যদি ধরে, কী অদৃষ্টে আছে কে জানে?
আচ্ছা, পাগল সাজলে কেমন হয়?
চমৎকার! চমৎকার! এতক্ষণ কেন মনে পড়েনি।
অজিতের মনে হল জগতের সমস্ত রকম অসুবিধে আর বিপদ, অপমান আর লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার এর থেকে সহজ উপায় আর নেই।
মনে হল এ চালটা মাধববাবুর বাসাতেও চালালে মন্দ হত না!
যাক।
এখন তো অজানা সমুদ্রে পাড়ি!..মাসের বাজার করা আছে মলিনার। মাসের মাইনেটাও আছে বাড়িতে। এক্ষুণি চট করে কষ্টে পড়বে না।
এখন পাগলের ভঙ্গিটা রপ্ত করা।
তা এখন থেকেই শুরু করলেই বা মন্দ কি?
সেই থেকে পাগলের ভূমিকা।
ক্রমশ যেন এইটাই স্বাভাবিক হতে চলেছে।
এখন আর গায়ে ছাই-কাদা মেখে, অথবা গালে-মুখে লাল-নীল রং মেখে নিতে বুকটা ফাটে না, যার তার জামায় টান দিয়ে বলে উঠতে দ্বিধা হয় না, এই শালা, আনা কতক পয়সা দে দিকি, পেটের মধ্যে খাণ্ডব দহন হচ্ছে।
পাগলে গাল দিলে কেউ রাগ করে না। বরং কথার চার ফেলে ফেলে আরও গালমন্দ আদায় করে, তবে দুআনা চার আনা পয়সা দেয়।
নেহাত যেদিন না জোটে, গিয়ে বসে পড়ে কোনো ছত্রে, পেটটা ভরে যায়।
ছত্রের খাওয়ায় পেটটা ভরলেও হয়তো মনটা ভরে না। এসে দাঁড়ায় কোনো খাবারের দোকানের সামনে, গিয়ে বলে ও দাদা, খুব যে খোসবু বার করেছ, চারটি ছুঁড়ে মারো না, এইখানে রাখি।
বলে আর পেটটা দেখায়।
.
পাগলের মতো কথা এখন আর ভেবে ভেবে সাজাতে হয় না ওকে, কথা আপনিই এসে হাজির হয় ঠোঁটের আগায়।
লজ্জাও হয় না।
এটা যে একটা বেশ মজাদার পেশা, সেটাই সে ধরে নিয়েছে।
আর এটাও ধরে নিয়েছে, এ পেশার পক্ষে কাশীই হচ্ছে উপযুক্ত ক্ষেত্র।
চোর-জোচ্চোর, ভিখিরি, পাগল, আর ধর্মের ষাঁড় এই জীবগুলোর জন্যে সদাব্রত খোলা আছে এখানে।
তাই শুধু যে পেটটাই ভরে যাচ্ছে তা নয়, পকেটেও কিছু কিছু উদ্বৃত্ত হচ্ছে।
তবে ওই পয়সাগুলো লুকিয়ে রাখার জন্যে অনেক পাঁচ কষতে হয়।
মণিকর্ণিকার ঘাটে যে সাধুটি রাতদিন ধূনী জ্বালিয়ে বসে থেকে ভস্মের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছে, তার সেই ভস্ম-পাহাড়ের খাঁজে এক খুরি পয়সা-টাকা আছে পাগলার, আর ঘাটের ওপর যে অশ্বত্থ গাছটা অনেক ঝুরি নামিয়ে বসে আছে অগুনতি বছর ধরে, তার একটা ঘন অন্ধকার ডালে ঝোলানো আছে একটা কৌটো ভর্তি টাকা। শ্মশানে কুড়িয়ে পাওয়া ময়লা ন্যাকড়ার টুকরো দিয়ে বেঁধেছে, পাছে কারও চোখে পড়ে যায়।
আর এসব করে সে রাতবিরেতে।
অথচ লোকটা নাকি একদা জাতে বামুন ছিল, নিরীহ ভদ্রলোক ছিল।
বাসায় কারও সঙ্গে একদিনের জন্যে বচসা হত না তার।
এই জীবনের মধ্যে আটকে গেছে সে।
যদিও ভাবছে অভিনয় করছি।
তবে এক এক সময় বউয়ের জন্যে মন বড়ো উচাটন হয়ে ওঠে।
তখন এই ঘৃণ্য খোলসটাকে বড়ো অশুচি মনে হয়। তখন এই পেশাটাকে নারকীয় মনে হয়।
আর তখনই প্রাণটা ছটফটিয়ে ওঠে সেই বিস্মৃতপ্রায় সহজ সুস্থ জীবনটার জন্যে।
ইচ্ছে হয় বউটাকে কোনো প্রকারে একবার কাশীতে এনে ফেলে। তারপর সব সহজ হয়ে যাবে।
কাশীতে থেকে বুঝেছে, রাজ্যটা যে মা অন্নপূর্ণার বলা হয়, সেটা ভুল বলা হয় না। উপপাসী এখানে থাকতে হবে না।
বামুনের মেয়ে তো, একটা কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। কিছু না হোক, একটা ঠাকুর মন্দিরে ফুল জল ফেললে, মন্দির ধোয়া মোছা করলে, পুজোর বাসন দুখানা মাজলেও পেটটা চলে যাবে।
আর–
কে জানে বউটার কী হচ্ছে। সারাদিনের ছলনার পর রাত্রে কোনো মন্দিরের আনাচে কানাচে শুয়ে ভাবে পাগলা।
অবিশ্যি, সামান্য যা কিছু সোনা-রূপো, কাসা-পেতল ছিল, তাতে চলেছে কিছুদিন। তারপর? তা অতগুলো ঘর কি আর এক মুঠো করে চাল চাঁদা দিয়ে একটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখছে না? আর বাড়িওলা?—ওর অবস্থা দেখে কি আর ঘর ভাড়াটা মাপ করছে না?
পাগলামির নেশায় সত্যিই যেন পাগল হয়ে থাকি আমি। একখানা চিঠিও তো লিখতে পারতাম! অন্তত বেঁচে আছি, এই খবরটুকু দিয়ে! কিন্তু
আমি পালিয়ে আসার পর নিশ্চয়ই ওরা আমার ওই আপিসে খোঁজ নিয়েছিল, আর যা শোনবার শুনেছিল।চোর স্বামী এই ঘেন্নায় গলায় দড়ি দেয়নি তো মলিনা? যে মানিনী!
এই কথাটা যেই মনে আসে, সত্যিই যেন মাথার মধ্যে পাগলেরই মতো হিজিবিজি হয়ে যায়। আর চিঠি লিখতে সাহস হয় না। ভাবে যা থাকে কপালে, গিয়েই পড়ব একবার। আশেপাশে জিগ্যেস করব, মলিনা বেঁচে আছে কিনা। তারপর যা আছে অদৃষ্টে।
এখন চিঠি দিলে হয়তো বিপদই বাড়বে। বিপদই হয়েছে চিন্তা।
এখন দরকার কিছু নগদ টাকার।