ছোঁকরা যে ঘরভেদী বিভীষণ, তা বোঝা যাচ্ছে। যার খায় তার চাল কাটে। তবে নীরেট বোকা।
মলিনা একটু নিশ্চিন্ত হয়।
বলে তোমার জ্যাঠামশাইকে বোললা, বাসা আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই থাকবে। দুজনেই আমরা পরিষ্কার মানুষ।
হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আচ্ছা আবার আসব। যা সুবিধে অসুবিধে হয় জানাবেন।
না না, অসুবিধের কি আছে? সুধানাথ বলে ওঠে।
মলিনা হঠাৎ একটু হেসে ওঠে, তোমার আবার সুবিধে অসুবিধে! সংসারের কিসে কি হয় জানো তুমি? ও ভাই, তোমাদের গোয়ালা আসে তো? আমার তো একটু দুধ চাই। অবিশ্যি বেশি নয়, পোয়াটাক, চায়ের জন্যে।
পাঠিয়ে দেব, গয়লা পাঠিয়ে দেব—
ছেলেটা বলে, বাসন মাজা ঝিও তো চাই আপনার?
বাসন মাজা ঝি? মলিনা হেসে ওঠে, না ভাই, ওসব বাবুয়ানীতে দরকার নেই। আমিই ওনার রাঁধুনী, বাসনমাজুনী, ঘরগুছানি সব।
এবার সুধানাথ বলে ওঠে, তা বাসনটা মাজবার জন্যে একটা—এই শুনুন, আমাদের তো এই দেখছেন সামান্য বাসন, তিন-চার টাকায় পাওয়া যায় না কাউকে?
তিন-চার টাকা! ছেলেটা মাথা নাড়ে, পাঁচ টাকার কমে রাজী হবে বলে মনে হয় না। আমাদেরই লোক, বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে বেড়ায়। তাই করে মাসে পঞ্চাশ টাকা রোজগার করে।
আরও খানিক বকবক করে চলে যায় ছেলেটা।
সুধানাথ বলে, যে প্যাটার্নের ছেলে দেখছি, যখন তখন এসে হানা দেবে মনে হয়।
মলিনা অদ্ভুত একটু হেসে বলে, তাতে আর ভয়টা কি? পার্টটা কেমন প্লে করা গেল? নিখুঁত হয়নি?
৫. অভিনয় ক্ষমতা
তা অভিনয় ক্ষমতা বোধ করি মানুষের সহজাত। তাই সহজ সুস্থ একটা মানুষ পাগলের পার্ট প্লে করেও কাটিয়ে দেয় ছমাস আট মাস। হাতে পয়সার বালাই নেই, তবু খাওয়াও জুটে যাচ্ছে, চেয়ে চিন্তে জুটে যাচ্ছে।
উলঙ্গ পাগল নয় যে, ধরে পুলিশে দেবে,-উন্মাদ পাগল নয় যে, ধরে কেউ ঠেঙাবে। এ হচ্ছে মজার পাগল!
কথার পাগল!
তাই আদর আছে লোকের কাছে।
সুস্থ লোকের কাছে পাগল বড়ো আকর্ষণীয় জীব। পাগলের মগজটা যেন একটা অজানা রত্নখনি, সেখান থেকে আহরণ করে তুলে নেওয়া যায় মণিমাণিক্য।
তাই পাগলের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা কয় লোকে, কুরে কুরে প্রশ্ন করে, খাওয়ার লোভ দেখিয়ে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, তার তারপর ক্ষেপিয়ে মজা দেখে।
এ সবই নাকি সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ!
এইসব সুস্থদের কাছে পাগলের আদর আছে।
তা লোকটা এদের বিপরীতে ভালোই অভিনয় করে চলেছে। মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ অনেক জায়গায় ছিটকে ছিটকে বেড়িয়ে, আশ্রয় নিয়ছে কাশীতে।
আর কাশীটা রীতিমতো ভালোই লেগে গেছে। তাই থেকে গেছে। ভাবে, এই বা এমন কি মন্দ পেশা? লোকে নাচ দেখায়, থিয়েটার দেখায়, ম্যাজিক দেখায়, ভঁড়ামি দেখায়, আমি না হয় পাগলামি দেখাই। ওসবেও পয়সা দেয় লোকে, এতেও দিচ্ছে। দোষ কি?
.
কিন্তু কবে থেকে ওর এই অভিনয়ের শুরু?
তা জানতে হলে ওই মাস আষ্টেক পিছনে সরে যেতে হয়।
যখন নাকি লোকটা আস্ত এটা মানুষ ছিল, বউ ছিল তার, বাসা ছিল।
বউ তার জন্যে পরিপাটি করে বেঁধে রাখত,—আর নিজে পরিপাটি হয়ে বসে থাকত, ও যখন ঘরে ফিরত, ওকে মনে হতো সম্রাট।
এই সম্রাটের জীবনেই হয়তো জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো লোকটা, যেমন আরও হাজার হাজার লোক দিচ্ছে। অসাধুতা করছে, অজ্ঞতা করছে বলে কে আর সাম্রাজ্য হারাচ্ছে?
হারজিত শুধু ধরা পড়ায়, আর না পড়ায়।
লোকটা ধরা পড়ে গিয়েছিল।
আর বড়ো মোক্ষমই ধরা পড়েছিল।
একেবারে সরাসরি মালিকের সামনে।
কাছার খুঁটে হোমিওপ্যাথি শিশিতে কুন্তলবিলাস বেঁধে নিয়ে সরে পড়া নয়, খদ্দেরের কাছে মকরধ্বজের পুরিয়া পাচার করছিল।
খদ্দেরকে বিদায় করে সিঁদুর আর মিহি ইটের গুঁড়ো মিশিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করছিল, অসময়ে এসে পড়লেন মনিব।
জেরার চোটে বেরিয়ে গেল সব।
অনেকদিন ধরেই এ ব্যবসা চলছিল।
সালসার বোতলে আধাআধি চিরেতার জল, বচূর্ণ মাজনে স্রেফ ঘুঁটের ছাই, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু প্রকাশ পেয়ে গেল। ওই খদ্দেরটিই এসব বুদ্ধি দিয়েছে অজিতকে, হাতে ধরে শিখিয়েছে। অর্ডার দিয়ে যায়, অজিত সাপ্লাই করে।
লাভজনক ব্যবসা।
তিল কুড়িয়ে তাল।
কর্তা বললেন, তুমি অনেকদিন আছ। তোমায় খুব বিশ্বাস করতাম। তাই পুলিশের হাতে আর দেব না, এই দণ্ডে আমার এখান থেকে বেরিয়ে যাও, জীবনে আর মুখ দেখিও না।
চাকরি গেল।
পকেটে একটাকা এগারো আনা পয়সা সম্বল।
এতদিনের সহকর্মীদের সামনে থেকে ঘাড় হেট করে বেরিয়ে আসতে হল।মনে হল, পৃথিবী দ্বিধা হও।
যে লোকটা তার কুমন্ত্রণাদাতা, তাকে মালিক আটকে রেখেছেন, নইলে হয়তো কিছু আদায় হত। অনেক পাওনা ছিল তার কাছে। সে এল না। অথচ পৃথিবীরও দ্বিধা হবার নাম নেই।
এই মুখ নিয়ে কি করে মলিনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে অর্জিত? এ খবর কি চাপা থাকবে? চাকরি যাওয়ার খবর চাপা থাকবে না, যাবার কারণও চাপা থাকবে না। মাধববাবুর বাসার সবাই জেনে ফেলবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র আর সবচেয়ে সম্রান্ত অজিত ভট্টাচার্যের এই কাজ! এই স্বরূপ!
না, এ মুখ নিয়ে বাসায় ফেরা যায় না।
অথচ এই একটাকা এগারো আনা পয়সা সম্বল করে এতবড়ো পৃথিবীতে কোথায় পাড়ি দেবে?
হাওড়া স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ ভাবল অজিত, তারপর একটা প্লাটফরম টিকিট কেটে ঢুকে পড়ে মারাত্মক ভীড় সম্বলিত একটা থার্ড ক্লাস কামরায় উঠে পড়ল।