আমি স্বপনকে ভাবি, স্বপনের মাকে ভাবি, দাস গিন্নি, মণ্ডল গিন্নি, সবাইয়ের কথাই ভাবি, এমনকি মাঝে মাঝে সুখদার কথাও ভাবি, অতএব ওকেও ভাবি।
তার বেশি নয়।
তবে কি আমি সত্যিই খারাপ? আমার মতো মেয়েকেই অসতী বলে?
একটা জিনিসও গোছায় না মলিনা, চুপ করে বসে থাকে।
একটু পরে সুধানাথ এসে পড়ে ঠেলা নিয়ে।
অবাক হয়ে বলে, এ কি গোছাওনি কিছু?
না!
না কেন বল তো? এরা কিছু বলেছে নাকি?
না, ওরা আবার কি বলবে?
আচ্ছা ঠিক আছে। আমিই গুছিয়ে নিচ্ছি।
তারপর—
সুধানাথ যখন হাত লাগিয়েছে, তখন আর কিছু ভাববার নেই।
সব করবে, গাড়ি ডেকে আনবে, মলিনাকে ডেকে তুলে নিয়ে যাবে।
পূর্বজন্মের কত শত্রু ছিলাম আমি তোমার!
বলে মলিনা। সুধানাথ হাসে, পূর্বজন্মের কেন, এজন্মেরই।
তাও মিথ্যে নয়। শুধু শত্রু কেন, শনি, রাহু সব।
গাড়িতে চলতে চলতে কথা হয় ভবিষ্যহীন ভবিষ্যতের।
মানিকতলার সরু এক গলির মধ্যে বাসাটা। কিন্তু মুশকিল এই, দুখানা ঘরের আস্ত একটা বাড়ি। ভাড়া তত বেশি-ই কিন্তু সেজন্যও নয়, একা কি করে থাকবে মলিনা, সেইটাই বলে সুধানাথ।
মলিনা তীব্রস্বরে বলে, তবু তোমার লোক-সঙ্গের সাধ?
সুধানাথ অপ্রতিভ হয়।
দুকানে হাত দিয়ে বলে, সাধ কিছুমাত্র নেই। লোকের নামে দুকান মলি। তবু তুমি একেবারে একা–
মলিনা গম্ভীরভাবে বলে, একেবারে একা কেন? বলছ তো দুখানা ঘর। তুমি তোমার শেয়ালদার দোকানের বাস উঠিয়ে চলে এস। একত্রে রাঁধাবাড়ায় খরচেরও সাশ্রয় হবে।
সুধানাথ স্তব্ধ হয়ে যায়।
সুধানাথ পাথরের পুতুল বনে যায়। তারপর সুধানাথ নিশ্বাস ফেলে বলে, ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা? মলিনা শান্ত গলায় লে, না ঠাট্টা করছি না, সত্যিই বলছি।
এটা কি সত্যি করে বলবার কথা?
কেন? অসম্ভবই বা কিসে? সাহস নেই?
সুধানাথ উঠে দাঁড়ায়।
চঞ্চলভাবে পায়চারি করতে করতে বলে, এত তাড়াতাড়ি তোমার এই জিগ্যেসের উত্তর দিতে পারছি না।
বেশ, একা রাত ভাবতে সময় নাও।
আগুন নিয়ে খেলতে তোমার সাহস হয়?
মলিনা অদ্ভুত একটা হাসি হেসে বলে, সৰ্ব্বস্ব যার পুড়েই গেছে, তার আবার আগুন নিয়ে খেলার ভয় কি?
লোকে মিথ্যে বদনাম দিচ্ছে, সে আলাদা কথা। কিন্তু–
মলিনা তেমনি করেই হেসে উঠে বলে, কিন্তু আর কি? তখন না হয় লোকে সত্যি বদনাম দেবে।
সুধানাথ উত্তেজিত গলায় বলে, তুমি কি আমায় পরীক্ষা করছ?
তোমায় নয়, আমায়। খোলা তরোয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটেই দেখি না একবার। পরীক্ষা হয়ে যাক সতী, কি অসতী!
সুধানাথ বসে পড়ে।
অনেকক্ষণ ঘাড় হেঁট করে বসে থেকে বলে, বেশ! তোমার যা ইচ্ছে।
আর এই শোনো–মলিনা হেসে উঠে বলে, বাড়িওলাকে বলতে যেও না-ভাই বোন।
সুধানাথ অবোধের মতো ওর কথাটাই আবৃত্তি করে, বলতে যাব না ভাইবোন?”
না! ওইখানেই যত গণ্ডগোল! যা সচরাচর হয় না, তাই হতে দেখলেই একশো দিকে একশো চোখ কটমটিয়ে ওঠে।
তবে কি বলব?
মলিনা নিতান্ত সহজ সুরে, যেন কিছু নয়, এইভাবে বলে, কিছু বলবে না, লোকের যা ইচ্ছে ভাবুক। যা স্বাভাবিক, তা ভাবলে কেউ কটমটিয়ে তাকাবে না।
সুধানাথ আর একবার ছিটকে দাঁড়িয়ে ওঠে। ক্রুদ্ধ গলায় বলে, কী করেছি আমি তোমার? কী অন্যায় ব্যবহার দেখেছ আমার কাছ থেকে, তাই এইভাবে জুতো মারছ আমায়?
এই দেখ–
মলিনা আস্তে এগিয়ে আসে। ওর একটা হাত ধরে বলে, রেগে অস্থির হচ্ছ কেন? আমি কি তোমায় অপমান করছি? যারা আজ অকারণে রাতদিন অপমান করছে, তাদের মুখের মতো উত্তর দিতে চাইছি। দুটো মানুষ যদি বাসা খুঁজে বেড়ায়, ও ছাড়া আর কোনো কিছু ভাবতে পারে না লোকে! ব্যতিক্রম দেখলেই ছুরি শানায়, বঁটা নিয়ে তেড়ে আসে, তাই ভাবছি, এই অবধি থিয়েটারই তো করা হচ্ছে, এখন আর একটা নতুন পার্ট প্লে করি। দেখা যাক, কেমন উৎরোই।
তা প্রথম ধাক্কাটা উৎরোলো বৈকি।
বলতে গেলে ভালোভাবেই উৎরোলো।
বাড়িওয়ালা অবশ্য ভাড়াটাদের সঙ্গে এক বাড়িতে নয়, তবে কাছেই তার বড়ো দোতলা বাড়ি। এই অঞ্চলে ছোটোখাটো ভাড়াটে বাড়ি তার বেশ খানকতক আছে। অতএব ব্যবস্থাও আছে।
বেকার ভাইপো আছে একটা, সে ভাড়াটেদের দেখাশোনা করে। এদের আসার সাড়া পেয়েই বাড়ির চাবি নিয়ে চলে এল। আকর্ণ হাস্যে বলল, যেমন বলেছিলেন, সক্কালবেলাই ঘর-দোর ধুইয়ে রেখেছি। রান্নাঘরে আপনার গিয়ে পাতা-উনুনও আছে, তাক আলমারি, খুব সুবিধের ব্যবস্থা।
ওকে ভাগাবার তালে সুধানাথ তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। যাক, করিয়ে রেখে অনেক উপকার করেছেন। আচ্ছা তাহলে–
এখন স্পষ্ট বিদায় হও শুনেও নড়ে না ছোঁকরা। তেমনি! ন্যরঞ্জিত মুখে প্রশ্ন করে, শুধু এই দুজন? বাচ্চা-কাচ্চা নেই বুঝি?
না।
তা ভালো! খুব ভালো! আমার জ্যাঠামশাই আপনাদের খুব নেক নজরে দেখবে। বাচ্চা-কাচ্চা দুচক্ষে দেখতে পারে না কি না! বলে একজোড়া করে পাখি আসবে, তার সঙ্গে একপাল করে ছানা। তার ওপর থাকতে থাকতে আবার ডিম পাড়বে।
মলিনা এসেই একটা জানলার ধাপের উপর বসে পড়েছিল। ঘরের মেঝেয় তখনও সকালের ঘর ধাওয়া জল গড়াচ্ছিল, তাই পা-টা গুটিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিল।
ছেলেটার সঙ্গে কথা কয়নি গোড়ায়। এখন কথা বলে ওঠে, ওঁর বুঝি নিজের ছেলেমেয়ে নেই?
নাঃ। তাতেই তো বাচ্চা অসহ্য। যে ভাড়াটে পাঁচটা কুচোকাঁচা নিয়ে আসে, তাদের ছুতোনাতা করে উঠিয়ে ছাড়েন। আপনাদের সে ভয় নেই।