স্বামীকে বাঁচাতে এমন বহুবিধ কথা বলে চলে সে। এবং দেখা যায় পাড়ার লোক তার প্রতিই সহানুভূতিশীল।
না হবেই বা কেন? একটা নষ্ট দুষ্ট মেয়ের প্রতি কার সহানুভূতি থাকে?
আর একা একটা বাসা ভাড়া করে থাকে কোনো শিষ্ট সভ্য মেয়ে?
অতএব ধরে নিতে হচ্ছে এ বাসাও গেল।
সুধানাথ হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা এরকম কেন হচ্ছে বল তো?
মলিনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, অলক্ষ্মী কিনলে এই রকমই দশা হয়। দেখছ না আমি বিষকন্যে! তোমায় দোহাই দিচ্ছি, তুমি আমায় ছাড়।
সুধানাথ একমিনিট চুপ করে চেয়ে থেকে বলে, বেশ, ধর ছাড়লাম। এই চলে গেলাম আর এলাম না। তারপর?
যা করবেন ভগবান। যা আছে কপালে।
কথাটা বলতে সোজা, ব্যাপারটা সোজা নয়। এমনও তো মনে করতে পার, ভগবান আমার মধ্যে দিয়েই তোমাকে দেখছেন। সব মানুষের মধ্যেই তিনি আছেন, একথা মান তো?
মানতে পাচ্ছি কই? মনে হচ্ছে ভগবান বলে কোথাও কেউ নেই।
সুধানাথ আস্তে বলে, এখুনি অতটা বিশ্বাস হারাবে কেন? মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ, সুবিধে অসুবিধে তো আছেই—আসবেই।
আমার জীবনটা কি অন্য কোনো মানুষের মতো?
বল কি? তুমি কটা জীবন দেখেছ? আরও কত বিপর্যয় আসে জীবনে!
দাদা বলতে বাধ্য হওয়া থেকেই তুমিটা রপ্ত করতে হয়েছে সুধানাথকে। অতএব কেমন করেই যেন মলিনার পোস্টটা ছোটোর মতোই হয়ে গেছে। সুধানাথ ওকে বুঝ দেয়, সান্ত্বনা দেয়, কখনও কখনও ধমকও দেয়।
সেদিন দিল ধমক।
যেদিন সুধানাথ আবার এসে একটা নতুন বাসার খোঁজ দেওয়ায় মলিনা বলে উঠল, যতই তুমি বল ভগবান মানুষের মধ্যে দিয়েই দেখেন, তবু আমি তোমায় হাত জোড় করছি, আমার চিন্তা ছাড়ো৷
সেদিন ধমকে উঠল সুধানাথা।
বলল, এই এক বাতিক হয়েছে দেখছি তোমার। তোমাকেই হাত জোড় করছি, ওই কথাটা বলা তুমি ছাড়ো। আশ্চর্য! চিন্তা করব না? কোনো মানে হয় কথাটার?
.
সুধানাথের মনে হয়েছিল মলিনার কথার মানে হয় না। তাই সুধানাথের হিসেবে যে কাজের মানে আছে, তাই করেছিল সুধানাথ উঠেপড়ে লেগে। কাজকর্ম কামাই দিয়ে বাড়ি খুঁজেছিল।
আর সাধনায় সিদ্ধি ঘটেছিল তার।
অথবা অসাধ্য সাধনের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সে।
তা কলকাতা শহরে নিত্য এক একটা বাসা খুঁজে ঠিক করে ফেলা অসাধ্য সাধন ছাড়া আর কি।
.
মলিনা বলে, আবার হয়তো সেখান থেকে দূরদূর করে খেদিয়ে দেবে।
সুধানাথ বলে, পরের কথা পরে আছে, এখন যে আজই এদের মুখের সামনে দিয়ে গট গট করে বেরিয়ে যেতে পারব, তাই ভেবেই স্ফুর্তি লাগছে আমার।
তা এই স্ফূর্তিটির জন্যে কতটি দাম দিতে হল?
কথাটা সুধানাথ বুঝতে পারলো না, অথবা না বোঝার ভান করল। তাই ভুরু কুঁচকে বলল, দাম মানে?
মানে? আমি একেবারে সোজা মানেটার কথাই জিগ্যেস করছি। ভাড়া কত দিতে হবে?
সে খোঁজে তোমার দরকার কি?
দরকার আছে। মলিনা বিষণ্ণ গলায় বলে, এই অলক্ষ্মীর জন্যে কতটা দণ্ড দিতে হচ্ছে তোমায়, জেনে রাখতে চাইছি।
লাভ কি জেনে?
হঠাৎ মলিনা আর এক দৃষ্টিতে তাকায়। খুব আস্তে বলে, জানতে পারলে নিজের দামটাও যাচাই হয়ে যেত!
সুধানাথ এ দৃষ্টির সামনে মুহূর্তকাল চোখ নামায়, তারপরই খুব খোলা গলায় বলে ওঠে, শুধু ওইটুকু থেকেই আপনি সেই দামটা যাচাই করবেন? আচ্ছা মেয়ে তো? নিন সব গুছিয়ে টুছিয়ে নিন। আমি একটা ঠেলা নিয়ে আসি।
অনেকদিন পরে আবার আজ হঠাৎ আপনি বলে।
সুধানাথ চলে যায়।
মলিনা তার সেই কদিনের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে।
গুছিয়ে নিতে হবে।
এই জঞ্জালগুলো আবার গুছিয়ে নিতে হবে তাকে?
এই বঁটি কাটারি, শিল নোড়া, ঝুড়ি কুলো, বাসন উনুন।
কেন?
কী দরকার এসবের? খেতে হবে?
সে তো ওই একটা অ্যালুমিনিয়মের বাটিতেই হয়ে যাচ্ছে সারা। ভাতে ভাত ছাড়া তো আর কিছু রাঁধেনি কোনোদিন তারপর থেকে।
শুধু একটা খাবার থালা আর ওইটা নিলেই তো চুকে যায়, আর সব থাক না পড়ে। বাড়িওলা টান মেরে ফেলে দেবে।
.
আশ্চর্য! এই জঞ্জালগুলোই একদা প্রাণতুল্য ছিল মলিনার।
আর কত চেষ্টায়, কত আগ্রহেই না সংগ্রহ করেছে এসব! অজিত বলত, কি হবে এত সবে? যত আসবাব বাড়াবে, তত খাটুনী বাড়বে।
মলিনা ঝঙ্কার দিত।
মলিনা বলত, তা বাড়ুক। তাই বলে বেদের টোলের মতোন সংসার হবে না কি? খাটুনী কমিয়ে আমি আর কোন মহৎ কর্ম করব শুনি?
অজিত জানত, এ ধরনের কথাবার্তার পরই একটি অশ্রুবর্ষণের পালা এসে পড়তে পারে। কারণ মলিনার যে আর পাঁচটা মেয়ের মতো আসল কর্মঠাই নেই, সেই অভাবটা উথলে ওঠে মলিনার এসব প্রসঙ্গে।
অতএব অজিত তাড়াতাড়ি বলত, থাকবে না কেন? পতিদেবতার পিঠটা একটু চুলকে দাও দিকি ভালোবাসা মাখিয়ে মাখিয়ে। ওর বড়ো মহৎ কর্ম আর কিছু নেই।
মলিনা বলত, আহা রে! কী একেবারে মহৎ কর্মের হিসেব নিয়ে এলেন! নারকেল কোরবার কুরুণী একখানা চাই আমার।
একটা মানুষের অভাবে যে সমস্ত জিনিসগুলো এমন মূল্যহীন হয়ে যায় জানা ছিল না মলিনার।
আজ তাই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
ভাবছে, আচ্ছা এত জঞ্জাল কেন জমিয়েছিলাম আমি?
এই তুচ্ছ জিনিসগুলোর জন্যে কত সময় কত উত্যক্ত করেছি মানুষটাকে!
কিন্তু হঠাৎ যেন চমকে ওঠে মলিনা। যেন হঠাৎ একটা অনাবিষ্কৃত দেশ দেখতে পায়।
আচ্ছা, ওকে আমি তেমন করে ভাবি কই?
ও কেন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে, নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে?