ধরা পড়ল। অনেক জেরার মুখে জোগাবার মতো বালি আর কুলেল না। বরং ভাঙন ধরলো আর এক ঘটনায়।
মাধব ঘঘাষের বাসার নগেনবাবু কদিন খুঁজে খুঁজে এ বাসায় এসে লীনার অজান্তে বাড়িওলার সঙ্গে আলাপ করে গেলেন।
তারপর গিন্নি ধরলেন সাট্টে পাট্টে।
প্রথমে ভালোমানুষী করে জিগ্যেসবাদ, ক্রমশ জেরা, অতঃপর উগ্রমূর্তি।
বললেন, দুদিন হলে, তিন দিন করবে না, আমার বাড়ি ছেড়ে দেবে। এত বড়ো পাহাড় মেয়েমানুষ তুমি, সোয়ামি রেলে কাটা পড়ল, সে কথা উড়িয়ে দিয়ে দুদিন না যেতেই একটা পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে এলে, আবার ভাই-বোন পরিচয়! ভাই-বোন সম্পর্কয় কলঙ্ক ধরানো! ছিঃ ছিঃ! তুমি বামুনের মেয়ে না? তোমার বরের নাম অজিত ভঠচায্যি ছিল না? ও ছোঁড়া কায়েৎ না?
এরপর আর কি দিয়ে বাঁধ দেবে মলিনা।
সুধানাথ এলে বাড়ির কর্তা হাল ধরলেন। বললেন, এই দণ্ডে পার, এই দণ্ডে! আমার এই ধর্মের বাড়িতে এত অনাচার! এমন ইসারাও দিলেন, সুধানাথ লোক দেখিয়ে সকালে এসে চলে যায়, তারপর কে জানে রাতের অন্ধকারে আসা-যাওয়া করে কিনা।
মাথা হেঁট করে বেরিয়ে আসতে হল সেই বাগান পুকুর ঘেরা স্নিগ্ধ ছায়ার আশ্রয় থেকে।
.
আমাকে তুমি ছাড়, বলল মলিনা। আবার আমায় ঘাড়ে করে করে বেড়াবে, আর কলঙ্কের বোঝা মাথায় তুলবে। এ কেন? কি দায় তোমার?
কি দায় আমার, বাঃ! সুধানাথ তাচ্ছিল্যভরে বলে, এ কথার কোনো মানে হয়? হঠাৎ তোমাকে ছাড়ব কিভাবে? গড়ের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসব?
সে যাই হোক, মলিনা উত্তেজিত হয়, আমার জন্যে তুমি মিনারের চাকরি ছাড়বে, বেলেঘাটায় বাস করতে যাবে, এর কোনো মানে হয় না। কেন তুমি এত করবে আমার জন্যে?
হঠাৎ সুধানাথের মুখের চেহারা কেমন একরকম হয়ে যায়। সুধানাথের চোখের দৃষ্টিতে কিসের যেন ছায়া পড়ে। সুধানাথ আস্তে বলে, সব কথা কি খুলে বলা যায়?
মলিনা মাথা নীচু করে।
মলিনার সিথির কালচে হয়ে যাওয়া অতীতের সিঁদুরের অস্পষ্ট রেখাটায় যেন সিথিটাকে ক্লেদাক্ত মনে হয়। মলিনা তারপর মুখ তুলে বলে, কিন্তু আমি এত দয়া নেব কেন?”
না হয় মনে করো, আমায় দয়া করছ।
৪. মিনারের চাকরি ছাড়ল সুধানাথ
সত্যিই মিনারের চাকরি ছাড়ল সুধানাথ।
শেয়ালদা অঞ্চলে একটা কাটা কাপড়ের দোকানে কাজ জোগাড় করে ফেলল, আর বেলেঘাটায় একটা বাসা ভাড়া করল।
এ বাসায় বাড়িওলা নিজে নেই।
আর একঘর ভাড়াটে আছে—মাত্র স্বামী-স্ত্রী। তাও নেহাত যেন বোকাসোকা মতো। সুধানাথ বলল, এই বেশ। চালাক পড়শী আগুনের সমতুল্য।
কিন্তু এ খেয়াল ছিল না সুধানাথের, বোকার লেজের আগুনেই লঙ্কাকাণ্ড বাধে।
প্রথম দর্শনেই সেই বউ বলে বসল, এই বেশ হল ভাই, আমরাও বরটি বউটি, তোমরাও বরটি বউটি। আমারও ছেলেপুলের বালাই নেই, তোমারও–
মলিনা তাড়াতাড়ি বলল, কি বাজে বাজে কথা বলছ? ও আমার দাদা।
দাদা! বউটা যেন এক ছুঁয়ে নিভে গেল। শুকনো মুখে বলল, দাদা আর বোন? এই সংসার?
দাদা তো থাকবে না, অন্য জায়গায় খাবে শোবে। আমার জন্যেই—
শুধু তোমার জন্যে? তা তোমার স্বামী?
স্বামী দেশে থাকেন। পাগল!
ওমা! সেই পাগল স্বামীর সেবা যত্ন ছেড়ে তুমি ভাইয়ের ভাতে কলকেতায় বাসা ভাড়া করে থাকতে এসেছ?
মলিনা অনেক সয়েছে।
মলিনা অনেক বদলেছে।
তবু মলিনা মানুষ তো! মেয়ে মানুষ! আর কত সইবে? তাই বিরক্ত স্বরে বলে, আমি কি করতে এসেছি না এসেছি, সে নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার কি? আমি তো তোমার সংসারে ঢুকতে আসিনি!
বউটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, বলছ তো ঢুকতে আসিনি। আসতে কতক্ষণ? এই তুমি একা সুন্দরী যুবতী, মাথার ওপর না শাশুড়ি ননদ, না স্বামী, দাদা পর্যন্ত থাকবে না বলছ। যার নাম একেবারে বেওয়ারিশ! আমার বরকে আমি সামলাব কি করে? সুন্দরী মেয়েমানুষ দেখলে ওর আর জ্ঞানগম্যি থাকে না!
মলিনা হাসবে না কাদবে? ডাকছেড়ে কাঁদতেই তো ইচ্ছে করছে, তবু মলিনা হেসেই বলে, তোমার স্বামীর সামনে আমি না বেরোলেই তো হল?
সে বেচারি এ আশ্বাসে কোনো ভরসা পায় না। চোখের জল ঠেকাতে ঠেকাতে বলে এক বাড়ি, এক ঘর, ওকি আর একটা কাজের কথা? তুমি না বেরালেও, ও তো ঘুরঘুরিয়ে বেড়াবে। সঙ্গে তোমরা একটা দুদে বর থাকত, আমি নিশ্চিন্দি থাকতাম। এ যদি রাতবিরেতে উঠে গিয়ে–
শেষ পর্যন্ত আর শোনার ধৈর্য হয় না মলিনার, নিজেই উঠে যায়।
কিন্তু চিন্তায় পড়ে।
এ বাড়িতে কি থাকা সম্ভব হবে?
সুধানাথকে বলতে লজ্জা করে, অথচ অস্বস্তিরও শেষ থাকে না।
সত্যিই, বেচারি বউটির জ্ঞানগম্যি-হীন বর ছুতোয়নাতায় মলিনার ধারে কাছে ঘুরঘুর করে, মলিনার জানলায় উঁকি মারে, স্নানের ঘরের ঘুলগুলিতে চোখ ফেলে বসে থাকে।
সাপের কামড় এক কোপ!
কাঠপিঁপড়ের কামড় অসহ্য!
সুধানাথকে না বলে পারা যায় না। আর শোনামাত্র শান্ত সুনাথের ভিতর থেকে এক দুর্দান্ত গোঁয়ার মূর্তি বেরিয়ে আসে।
যে মূর্তি ছুটে গিয়ে অপরাধীর ঘাড় চেপে ধরে।
বলা বাহুল্য, পরবর্তী ঘটনা এক কুৎসিত কেলেঙ্কারির রূপ নেয়। পতির বিপদাশঙ্কায় পতিব্রতা সতী পরিত্রাহী চিৎকারে পাড়ার লোক জড় করে, এবং সত্য নামক দেবতার মাথায় লাঠি বসিয়ে সক্রন্দনে বলতে থাকে, ওগো এতদিন সয়ে সয়ে আছি, তোমাদের বলিনি। ওই একটা নষ্ট মেয়েমানুষ পাগল স্বামীকে দেশে ফেলে রেখে পাতানো দাদার সঙ্গে চলে এসে বসে আছে, আর আমার ভালোমানুষ স্বামীকে নষ্ট করবার তালে নিত্যদিন হাসছে, ইসারা করছে, ডাকাডাকি করছে। তা চোরের সাতদিন, সাধুর একদিন! আজ ওর ওই ভাই না ভালোবাসার লোক কে, তার সামনে ধরা পড়ে গেছে। এখন ও এসেছে আমার স্বামীকে খুন করতে