ভাবল, বড়ো সুন্দর জায়গাটি আবিষ্কার করেছে সুধানাথ। এমন নিঃসঙ্গ নির্জনতাই তো এখন মলিনার কাম্য। অনেকের দৃষ্টির কলুষ সহ্য করবার ক্ষমতা কি তার আর আছে?
থাকার মধ্যে দুটো বুড়ো বুড়ি।
তাও দোতলায় থাকে।
এক আধবার আসবে। একটু ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে। ভুললে চলবে না, সে সুধানাথ মিত্তিরের বোন।
সুধানাথ এলে আর বলা হল না মলিনার, আমাকে পুরনো বাসায় রেখে এস।
বাগানে বুড়ি শাক তুলছিল, তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ও দাদা, দাদাগো, কী চমৎকার জায়গা খুঁজে বার করেছ। মনে হচ্ছে সেই আমাদের ছোটোবেলার গাঁয়ে এসে পড়েছি।…আহা এমন বাড়িতে তুমি থাকতে পাবে না দাদা!…আর একটা যদি ঘর থাকত!
সুধানাথ কাছে এসে হেসে বলে, এত এরকম দাদা দাদা করলে তো–তুই না ডাকলে মানায় না।
তা ডাকো! যেটা মানানসই সেটাই কর।
এদিকে তো দাদা ছোটো বোনের নাম জানে না।
ওমা তাই নাকি? গিন্নিরা তো ডাকতেন শোননি?
আমি আর কবে বাড়ি থেকেছি?
তা বটে। তা জেনে রাখো, আমার নাম মলিনা।
মলিনা!
সুধানাথ নাক কুঁচকে বলে, এ, মানানসই কোথায়? একেবারে বেমানান! এ নাম অচল।
এতদিন চলে এল, আর এখন অচল?”
হুঁ! পদবী যখন পালটেছে, নামও পালটাক। মলিনা নয়, মণিলা।
মণিলা আবার নাম হয়?
হওয়ালেই হয়।
লাভ কি?
মলিনা শুনতে বিচ্ছিরি।
হঠাৎ কথাটা ভারী অদ্ভুত লাগে মলিনার। তার এই উনত্রিশ বছরর জীবনে একথা তো কেউ কোনোদিন বলেনি! অজিত তো মলিনা মলিনাই করেছে, কোনোদিন বলেনি শুনতে বিচ্ছিরি।
মলিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুধানাথ একটু ভয় পায়। বলে, রাগ করলেন?
মলিনা হেসে ফেলে বলে, করলেন? আবার আপনি! তুমিই ফঁসাবে দেখছি।”
সুধানাথ জিভ কাটে।
তারপর বলে, তা হলে রাগ নয়?
না রাগ কিসের! তবে নামটা ছোটো করেও নিতে পার। লীনা বলতে হয়।
লীনা! লীনা! তা মন্দ নয়।
বাড়িওলা-গিন্নি চারটি শাক এনে ধরেন, মেয়ে শাক খাওতো?”
ওমা খাব না কেন? শাক ভাতই তো সম্বল মাসিমা।
আহা ষাট! এয়োস্ত্রী-মানুষ! তা নামটি কি গো?
নীনা।
লীনা? তা ওসব শক্ত নাম আমার মুখে আসবে না, লীলাই বলব! ভাই খাবে তো তোমার কাছে?
কোথা? মলিনা বলে, ওতো এক্ষুনি চলে যাবে। দেখুন না, এমন কাজ, খাবার সময় নেই। শুধু নিজের জন্যে রাঁধতে ভালো লাগে?
তা তো সত্যি। বলে চলে যান গিন্নি শাকগুলি নামিয়ে রেখে।
মলিনা মৃদু হেসে বলে, আর একবার নাম পালটালো।
জীবনটাই তো ওলট-পালট।
গিন্নি আমায় একটু কম ভালোবাসলে হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে বড় বেশি ভালোবাসেন।
সেটা বোধহয় আপ–থুড়ি, তোমার স্বভাবের গুণ।
স্বভাবের গুণ!
মলিনার স্বভাবে কোনো গুণ আছে, একথাই বা কে কবে বলেছে? সবাই তো মলিনার মেজাজের নিন্দেই করে। অজিত তো ফি হাত বলতো, রণচণ্ডী! বলতো বাবাঃ আগুনের খনি!
মলিনার সে স্বভাবের যে পরিবর্তন হয়েছে, ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় মলিনা গুঁড়ো হয়ে গেছে, এ মলিনা নিজে টের পায় না।
আর এও জানতে পারে না ওই সুধানাথই মলিনাকে উঁচু নাকী বলে অভিহিত করত।
রোজ সকালে একবার করে আসে সুধানাথ। কি আছে নেই দেখতে।
অভিনয় চলে। লীনা, তুই বলে হেঁকে হেঁকে কথা বলে। বলে, কী রাঁধছিস, কি? শুধু আলুসেদ্ধ ভাত? কেন, মরতে হবে না কি? তবে তিলে তিলে আর কষ্ট করা কেন? গলায় এক গাছ দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়!
গলা তুলে বলে, আর গলা নামিয়ে হাসে।
সেই নামানো গলায় বলে, এর চেয়ে সিনেমা থিয়েটারে নেমে পড়লে আখের গুছিয়ে নেওয়া যেত। তার চাইতে তো কম করছি না।
করছে না!
সত্যিই কিছু কম করছে না। দুজনেই!
সুধানাথ চলে যাবার মুখে মলিনা হেঁকে হেঁকে বলে, ও দাদা, তা এক বাটি খেয়ে যাও অন্তত। রোজ অমনি মুখে চলে যাও।
সুধানাথ আরও হেঁকে, যাতে দোতলার ঘর ভেদ করে কণ্ঠস্বরটা পৌঁছয় সেইভাবে বলে, আজ আর নয়, কাল। কাল চায়ের সঙ্গে চিড়ে ভেজে রাখিস।
এমন যে পারবে তারা, এ একেবারে ধারণাই ছিল না। এ যেন এক মজার খেলা! সত্যিই যেন অভিনয়ে নেমে পার্ট প্লে করছে দুজনে। যত করে তত পুলকিত হয়, তত কথার জোগান আসে, তত হাসিতে ঔজ্জ্বল্য আর ভঙ্গিতে সাবলীলতা আসে।
তবু পণ্ড হল।
তবু শেষ রক্ষা হল না!
প্রথমে মাঝে মাঝে তাল ভঙ্গ।
গিন্নি বলেন, হ গা লীলা, তুমি যে বলেছিলে এখানে আসার আগে শিবপুর থাকতে, আর তোমর ভাই ওনার কাছে বলল, গড়েয় না কোথায় থাকত?
মলিনা যদিও চটপট বলে, গড়েয় আর কদিন থেকেছি মাসিমা! কুল্লে একটা মাস। ভাড়া বেশি বলে ছাড়তে হল। তবু মলিনার হঠাৎ শুকনো হয়ে আসা মুখটা ক্ষীণদৃষ্টি বুড়িরও নজর এড়ায় না।
আবার একদিন ধরেন, হ্যাঁ গা লীলা, তোমাদের ভাই বোনের কথার মিল নেই কেন বল তো? তুমি বললে তোমাদের দেশ নবদ্বীপের কাছে পাটুলী, আর ও বলল, মুর্শিদাবাদ। এমন উল্টোপাল্টা কথা আমরা পছন্দ করি না।
মলিনা কষ্টে হেসে বলে, বিয়ে হওয়া মেয়ের দেশটা যে আর বাপ ভাইয়ের দেশ থাকে না, সে কথাও কি ভুলে গেলেন মাসিমা?
তবু বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তুমি তো পাটুলীতে তোমার ছেলেবেলার খেলার গল্প করলে–।
মলিনা তবু বাঁধ দেবার চেষ্টা করে।
মলিনা তবু হাসে, তা মাসিমা ছেলেবেলা ছাড়া আর কি! বারো বছরে পড়তেই বিয়ে, খেলারই তো বয়েস!
কিন্তু এই ঝুরো বালির বাঁধে কত দিন আটকানো যায়?