মলিনা মুখ তুলল।
মলিনা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলল, তাহলে ঢুকতেই দেবে না।
.
সুধানাথ চলে গেল।
পথে বেরিয়েই যেন অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেল। আর মলিনার মনে হল—ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করল ও।
এইখানে মলিনাকে একা ফেলে রেখে চলে গেল। একবার ওর অসহায়তার কথা চিন্তাও করল না!
অজিত যেদিন হঠাৎ আর এল না, সেদিনও বুঝি এমন অসহায়তা অনুভব করেনি মলিনা। বারো সংসারের উত্তাপ যেন মলিনাকে ঘিরে রেখেছিল। একঘরে হয়ে পড়ে থেকেও এমন ভয় করেনি।
কিন্তু আর কি-ই বা করার ছিল সুধানাথের? চলে যাওয়া ছাড়া?
এই একটা ঘরের বাসায় সে কোথায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মলিনার ভরসা জোগাত?
.
দরজায় খিল লাগিয়েছে।
জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখল মলিনা। বোধ করি অমাবস্যার কাছাকাছি কোনো তিথি। তাই আকাশ, মাটি সব অমন নীর অন্ধকার। ঠিক যেন মলিনার ভবিষ্যৎ।
পৃথিবীর এই অন্ধকারের মুক্তি হবে। আকাশে নতুন সূর্য উঠবে। কিন্তু মলিনার?
তারপর ভাবতে লাগল, মাধব ঘোষের বাসাটা চট করে ছেড়ে আসা কি ঠিক হল?—যদি–সুখদার চোখ নির্ভুল না হয়, যদি অজিত কোনোদিন ফিরে আসে?
যদি আজকালই আসে?
দুমাস আসেনি বলে যে, দুমাস পাঁচদিনের দিন আসতে পারে না, তা তো নয়!
এসে দাঁড়িয়ে যদি ওই বারো ঘরের সামনে প্রশ্ন করে, মলিনা কোথায়?
ওরা কে কি উত্তর দেবে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় মলিনা। দেখতে পায় দাস গিন্নির, মণ্ডল। গিন্নির, নগেন গিন্নির আর সুখদার ঘৃণায় বিকৃত মুখ…
তারপর অজিতের মুখ দেখতে পায়।
কিন্তু এ কি!
অজিতের মুখের একটা কুঞ্চিত পেশীর ভঙ্গি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন মলিনা? আর সব কেমন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে।
অজিতের মুখটা কি মলিনা এই দুমাসেই ভুলে গেল?
এ কি হচ্ছে ভগবান!
সেই ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন মুখ শবদেহটাই অজিত হল না কেন? অজিত কেন ঝাঁপসা হয়ে গিয়ে মলিনাকে আঙুল তুলে শাসাবে? কেন তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলবে, কি গো, তিনটে মাসও পারলে না এই হতভাগার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে?
সুনাথের ওপর তীব্র একটা রাগ পাক দিতে লাগল মনের মধ্যে। ও যদি ওপরপড়া হয়ে এত না করতে আসতো, নিশ্চয়ই আর পাঁচজনে দেখত।…হয়তো—বারো ঘরে চাঁদা করে মলিনার মাসকাবারি বাজার তুলে দিত। হয়তো পালা করে এক একজন এক একদিন নিজেদের বাজার থেকে আলুটা বেগুনটা দিত, হয়তো মলিনার সেই দুর্দশা দেখলে মাধব ঘোষ, সত্যিই ভাড়া চাইত না। আর হয়ত ক্রমশ মলিনা রাঁধুনীগিরিতে পাকা হয়ে উঠত।
সমস্ত সম্ভাবনাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে ওই সুধানাথ!
ঈশ্বর জানেন ওর কি মতলব! এখন তো ভাইবোন, দাদাদিদি, অনেক ভালো ভালো সম্পর্ক পাতাচ্ছে, পরে কি মূর্তি ধরবে কে জানে! শুনেছি সিনেমায় কাজ করে। আমাকে কারুর কাছে বেচে দেবে না তো? গোড়া থেকেই তাই আমাকে গ্রাস করছে?
মলিনা নিজেই যে গোড়ার দিন এতগুলো চেনা লোককে বাদ দিয়ে ওই সামান্য চেনা ছেলেটাকেই আশ্রয় বলে গণ্য করেছিল, ঠাকুরপো ডেকে অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করেছিল, আর অতগুলো লোকের একজনও অজিতের জন্যে একটা আঙুল নাড়েনি, সুধানাথই সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, এসব ভুলে যায় মলিনা।
মলিনা শুধু সুধানাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমিয়ে তুলতে থাকে।…
বলতে থাকে, ওই আমার শনি!
ওই আমার রাহু!
আমার পাঁজরের হাড় খুলে খুলে ছড়িয়ে দিল ও! সেই আমার সাজানো ঘর, সে চলে গিয়েও যেখানে যা অবিকল ছিল, সেই ঘর তছনছ করে যেন দস্যুর মতো লুটে নিয়ে এল আমাকে!
নিশ্চয় ধুলো পড়া দিয়েছে ও আমাকে। জানে বোধহয় কিছু। নইলে আমার এমন বুদ্ধি হয়ে গেল কেন!
প্রতিনিয়ত যে সেই সহানুভূতিহীন, নিষ্ঠুর ঠাই থেকে পালাবার জন্যে ছটফট করছিল মলিনা, সেকথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ওখানের সক্কলের জন্যে মন কেমন করছে তার। এমনকি আধা-হাবা, ভোলা মদনাটার জন্যে পর্যন্ত।
এবারে পুজোয় স্বপনকে সে একটা জামা দেবে ভেবেছিল। পুজোয় বোনাস পায় অজিত। ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারতো মলিনা। স্বপনের মা তাকে ভালোবাসে, স্বপনকে মলিনা ভালোবাসে।
ওদের কাছ থেকে মলিনাকে ছিনিয়ে নিয়ে এল সুধানাথ।
নিয়ে না এলেও যে ওসব কিছু হতো না, সেকথা ভাবছে না মলিনা।
অনেক ভেবে, অনেক কেঁদে, শেষ অবধি সংকল্প করল মলিনা, কাল সুধানাথ এলেই বলবে, আমায় সেই পুরনো বাসাতেই রেখে এসো। নিজেই একটা রাঁধুনীগিরি জুটিয়ে নিয়ে চালাব আমি। একটা পেট, এত কি ভাবনা! পরের দয়াই বা নেব কেন বারোমাস? তুমি আমার কে?
এই সিদ্ধান্তটা করে যেন অনেকটা শান্তি বোধ করল মলিনা। শেষ রাত্রের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙল, হঠাৎ যেন সব ওলট-পালট হয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল।
মরি মরি, এত সুন্দর জায়গা।
আর রাত্রে অত বিভীষিকা দেখছিল মলিনা।
গাছপালা বাগান পুকুরে ঘেরা বাড়িখানা যেন মলিনার দূর শৈশবের পিতৃভূমিকে মনে করিয়ে দিল।
ওই পুকুরটা যে রাত্রে জানলা দিয়ে একটা অন্ধকারের গহুর মনে হচ্ছিল, আর ওর ধারের নারকেল গাছগুলোকে এক পায়ে খাড়া দৈত্যের মতো লাগছিল, সে কথা ভেবে হাসি পেল মলিনার।
বাড়িটা ছোট্ট, জমিটা অনেকখানি। সবুজ ঝোঁপঝাড়ের মাঝে মাঝে গাছ আলো করে ফুটে থাকা জবা, করবী যেন মলিনার জ্বরতপ্ত মনে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল।