তা তেমন করে তলিয়ে দেখতে কজন পারে?
অজিত ভঠ্চায তো কোন্ ছার।
বোধ বুদ্ধি হবে কিসে? ম্যাট্রিকটাও তো পাস করেনি, বার দুই ফেল করে ওই চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেছিল।
আর বিয়েটাও করে ফেলেছিল সেইটুকুর ওপরই নির্ভর করে।
মা-বাপ মরা মলিনা দূর সম্পর্কের কাকার বাড়িতে জুতো সেলাই চণ্ডীপাঠ করে মুক্তির জন্যে ছটফটাচ্ছিল, কবরেজের দোকানের প্যাকারও তার কাছে মুক্তিদাতার মূর্তিতেই দেখা দিল। ওকে পেয়েই সুখী হল মলিনা।
আর তাইতেই সে যেন সুখী সুখী হবার অধিকারও পেল।
তা ওকে ওই সুখীর ভূমিকাতেই প্রতিষ্ঠিত রাখবার জন্যে অজিত ভটচায মনিবের জিনিস না বলে চেয়ে নেবার সহজ পথটা বেছে নিয়েছিল। শেষরক্ষা হল না। মলিনা নামটাকে আছড়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেল এক অজানালোকে।
.
বাসাটা জোটা আশ্চর্যি!
একালে কেউ ভাবতেই পারে না, একদিনে বাসা জোগাড় হয়। কিন্তু রাগের চোটে বোধ করি অনেক অসাধ্যসাধনই হয়।
একে ওকে বলতে বলতে হঠাৎ একজন বলল, বাসা আছে একটু দূরে, রোজ এতটা আসা যাওয়া করতে পারবে?
সুধানাথ বলল, না পারলে চলবে কেন? লোকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছে।
তা পুরনো বাসার কি হল?
ঝগড়া হয়ে গেছে।
শহরতলীর আর এক কোণ!
তা হোক, যতটা দূর বলেছিল তত কিছু নয়। ছোট্ট বাড়ি, সস্তায় তৈরি। বাড়ির গায়ে পলস্তারা পড়েনি জীবনে।
তবু দোতলা!
নীচের তলায় একখানা, দোতলায় একখানা ঘর।
দোতলায় বাড়িওলা আর বাড়িওলা-গিন্নি থাকেন। একতলার ওই ঘরখানি থেকে কিছুটা আয় করেন।
.
ভাড়া যখন নিতে গিয়েছিল, গিন্নি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, বলছ তো বোন আছে সংসারে, তা একখানা ঘরে থাকবে কি করে?
সুধানাথ বলল, বোনই থাকবে, আমি অন্যত্র থাকব, দেখাশোনা করে যাব। এই জন্যেই তো আপনাদের মতো একটি আশ্রয় চাইছি।
গিন্নি মনে মন বললেন, কি জানি, কেমন ধারা বোন! মুখে বললেন, বড়ো বোন?”
না, ছোটো। পিঠোপিঠি।
বিধবা?
একরকম বিধবাই। স্বামী নিরুদ্দেশ।
গিন্নি মনে মনে বলেন, স্বামী নিরুদ্দেশ কি তোমরাই নিরুদ্দেশ, তোমরাই জানো। কলিতে কাউকে বিশ্বাস নেই। বোন বললেই বোন।
মুখে বললেন,—”শ্বশুরবাড়িতে কেউ নেই?
থাকলে আর আমার এত জ্বালা!
মা বাপ?
অনেককাল পাট চুকেছে।
বোনের ছেলেমেয়ে আছে?
নাঃ! ভাগ্যিস নেই, তাহলে আমি তো মরেই যেতাম।
হুঁ! তা তুমি বে-থা করনি?”
কই আর করতে পেলাম? সামান্য চাকরি, বোনকে পুষতে হয়।
কর্তাকে জানালেন গিন্নি।
কর্তা বললেন—”মরুক গে। ছেলেটা তো থাকবে না বলছে—
.
গাড়িতে আসতে আসতে মলিনা একবার জিগ্যেস করেছিল, কী পরিচয় দিলে?
বলে দিলাম বোন! ওটাই ভালো। বউদি-টৌদি অনেক ঝামেলা। তবে মুশকিল এই—ছোটো বোন বলে বসে আছি। এখন আপনার তো আমাকে দাদা বলতে হয়।
সেটা খুব শক্ত নয়। তুমিই আমাকে আপনি বলে বসবে, এই যা।
সেরেছে! ওটা তো মাথায় আসেনি। বুড়ির যা জেরা, বাবাঃ! জেরার মুখে যা মুখে এসেছে বলে দিয়েছি–
মলিনা শঙ্কিত হয়।
মলিনা মলিন হয়ে যায়।
মলিনা আস্তে বলে, খুব জেরা করল?
খুব মানে কি? এমনি, মানে মেয়েলি কৌতূহল আর কি! বড় বোন না ছোটো বোন, বিধবা সধবা, কোলে ছেলেমেয়ে আছে কি নেই, শ্বশুরবাড়ির সবাই সরে গেছে কেন? মা বাপই বা হাওয়া হল কবে? আমি কেন বিয়ে করিনি?—এইসব বহুবিধ মূল্যবান প্রশ্ন।
মলিনা মাথা নীচু করে বলে, আমার ভয় করছে।
ভয়ের কি আছে?
যদি সন্দেহ করে?
সন্দেহ অমনি করলেই হল? তবে হ্যাঁ, ওই দাদা আর আপনির সমস্যাটা! তালগোল না পাকিয়ে যায়।
আমার যাবে না তোমার যেতে পারে। এখন থেকে শুরু কর।
বাসায় যখন ঢুকল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে কেমন গ্রাম গ্রাম ভাব, বুনো বুনো গন্ধ বেরোচ্ছে। আর পলস্তারা ছাড়া বাড়িটা ঝোঁপের আড়ালে যেন ছায়ামূর্তির মতো গুঁড়ি মেরে বসে আছে।
মাধব ঘোষের বাসায় আর যাই হোক, প্রাণ ছিল। এ যেন মরে পড়ে আছে।
এ কোথায় এনে তুলল সুধানাথ মলিনাকে?
ইচ্ছে হল বলে, মনে হচ্ছে কবরে প্রবেশ করছি।
বলল না।
সাড়া পেয়ে বাড়িওলা গিন্নি নামলেন। বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন মলিলকে। আর দেখে যেন একটু সন্তুষ্টই হলেন। পালিয়ে আসা খারাপ মেয়ের মতো দেখাচ্ছে না। নেহ যেন দুঃখী দুঃখী, বিষণ্ণ বিষণ্ণ। যা বলেছে তাই হবে।
স্নেহপরবশ হয়ে বললেন, রাতে কি আর রাঁধতে পারবে? আমি বরং দুটো দানা ফুটিয়ে দিই–
সুধানাথ বলল, পাগল হয়েছেন! আপনি বুড়ো মানুষ, আপনি খাটতে যাবেন কেন? আমি তো বাইরেই খাই, বোনের একটু মিষ্টি-টিষ্টি খেলেই হয়ে যাবে। এই ইয়ে–
হঠাৎ থেমে গেল সুধানাথ।
অজিত ভট্চাযের স্ত্রীর নাম তো জানে না সে।
গিন্নি অতটা লক্ষ করলেন না।
বললেন, তা মেয়ে আমার কাছে খেতে পারত। আমরাও ছোটো জাত নই, তোমাদের মতনই মিত্তির-কায়স্থ।
দেখিয়ে শুনিয়ে দিয়ে উনি চলে যেতেই মলিনা দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়ল। মাধব ঘোষের বাসায় তো তবু সব সত্যি ছিল, এ যে আগাগোড়া ছলনা হয়ে গেল। এ কি চালিয়ে যাওয়া সোজা? আমি মলিনা ভটচায–
সুধানাথ মাথা চুলকে বলে, মানে ব্যাপারটা হল কি—আমি তো মিত্তির।
বুঝেছি! কিন্তু বরদাস্ত করতে পারছি না, প্রতিপদে মিথ্যে পরিচয়, ধরা পড়ে যাবার ভয়–
সুধানাথ সহসা ঘোষণা করে, ঠিক আছে, দুচারটে দিন যা হোক করে চালান, অন্য বাড়ি দেখে চলে যাব। সেখানে সব সত্যি কথা বলে ঢুকব।