- বইয়ের নামঃ দুই নায়িকা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. খবরটা এনেছিল মাধব
খবরটা এনেছিল মাধব ঘোষের বিধবা শালীর সেই আধাহাবা ছেলেটা। যে ছেলেটাকে আর যে শালীকে নিয়েই মাধব ঘোষের সংসার।
বাড়িওলার আদরের পুষ্যি, তবু ছেলেটাকে কেউ মানুষের দরে গণ্য করে না। আর বাইরে থেকে এক একটা খবরের ঢেউ বয়ে এনে হাঁফানোলাফানোই তো কাজ তার! কে শুনবে সে খবর? মাধব ঘোষের বাসার ভাড়াটের মধ্যে কারই বা এত সময় আছে যে গালগল্প করবে বসে?
তাই সে যখন হাঁফিয়ে তোলামি করে আর হাত মুখ নেড়ে বলছিল, ও বাবা, সে কি রক্ত! যেন এক কুড়ি পাঁঠা কেটেছে—তখন নিতান্ত কৌতূহলী দুএকজন রান্নার চালা থেকেই মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করেছিল, কোনখানে রে?
কেউ কিছু জিগ্যেস করলেই ছেলেটা আরও ভোলা হয়ে যায়। উত্তর পেতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, তাই ওরা বাড়ানো মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আপন মনে বলেছিল, ভগবান পৃথিবীর ভার কমাচ্ছে। এই সেদিন ওখানে একটা গরু কাটা পড়ল।
তা একটা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে একটা গরু-মোষের পার্থক্য কি? গরু বরং ভগবতী। কাটা পড়েছে শুনে মেয়ে মানুষের মন একবার শিউরে উঠতে পারে। মানুষ একটা রেলে কাটা পড়েছে, এ খবরের নতুনত্ব কোথায়?
পৃথিবীতে দৈনিক হাজার হাজার মানুষ এক্সিডেন্টে মরছে না?
তখন ভর দুপুর।
বাড়ির জোয়ান পুরুষরা সকলেই কাজের ধান্দায় বাইরে। মেয়েরা কেউ কেউ সকালের পাট সেরে রাতের রান্না সারতে বসেছে। কেউ কেউ ইস্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের জন্যে রুটি গড়ে রাখছে, আর ছোটো সংসারের কেউ কেউ ভাতের কঁসি নিয়ে বসেছে। খেয়ে উঠে ছাই মাটি শালপাতা আর পোড়া কড়া নিয়েও বসেছে এক আধ জন।
মাধব ঘোষের বাসায় তেরো ঘর ভাড়াটের ঘরে তেরো রকম কাজ চলছিল তখন। আধাহাবা মদনার সঙ্গে রেলেকাটা দেখতে ছুটবে, এত উৎসাহ কারুর আসেনি।
হোক না বাড়ির কাছাকাছি, খেটে পিটে ক্লান্ত সবাই। হ্যাঁ, নিজেদের বাড়ির পুরুষরা বাড়ি থাকত, তা হলেওবা তাদের ছায়ায় ছায়ায় গিয়ে না হয় উঁকি দেওয়া যেত।
তাও এসব হ্যাঙ্গাম হুজুতে উঁকি দেবার সখ পুরুষদেরও বড়ো থাকে না। কে জানে বাবা, আবার পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হবে কি না, সাক্ষী দিতে যেতে হবে কি না।
কাজেই মদনা, যতই হেই হেই করে বলুক দেখবে তো চল। এখনও পড়ে আছে কেউ গ্রাহ্য করেনি। বরং অজিতের বউ মলিনা কয়লা ভাঙতে ভাঙতে একবার হাতের শব্দ থামিয়ে কথাটা শুনে নিয়ে বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল,—এ ছোঁড়ার কাজের মধ্যে কাজ যত হাড়হাবাতে উনচুটে খবর বাড়িতে নিয়ে আসা।
মদনার মা সুখদা শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেছিল ছেলেকে। হারে মেয়ে না বেটাছেলে? …বেটাছেলে? জোয়ান? মুণ্ডুটা একেবারে থেঁতলে গেছে? তা কি বলছিল লোকে? নেহাত অপঘাত লো আত্মহত্যে?
সুখদার ছাছোলা গলার প্রশ্ন কিছু কিছু শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু তোলা মদনার উত্তর আর কারুর বোধগম্য হচ্ছিল না।
তারপর মদনার মা ছেলেকে রোদে ঘোরার জন্যে বকে, হাতে মুখে জল দিয়েই তার মেশোর কাছে শুইয়ে রেখে গেল।
মাধব ঘোষের ঘরে একটা ঘাড়-নড়া টেবিল ফ্যান আছে, সেই সুখের আস্বাদের ভাগ সুখদা নিজের ছেলেকে না দিয়ে ছাড়ে না। আর কাজকর্ম সারা হলে, নিজেও এসে মেঝেটায় গড়াগড়ি দেয়।
তা কাজকর্ম তাকেও নিজের হাতেই করতে হয়, বাড়িওলার শালী বলে যে বাসন মাজতে ঝি রেখেছে তা নয়। রাখতেই বা দেবে কেন মাধব ঘোষ? একাধারে ঝি, রাঁধুনী, ঘরগুছুনি পাওয়া যাবে বলেই না দু দুটো মানুষকে ভাত কাপড় দিয়ে পোষা।
মাধব ঘোষের বাসার এই ভাড়াটেরাও সে হিসাব জানে। তাই সুখদা নিজে যতই আস্ফালন করুক, বাড়িওলির মর্যাদা তাকে কেউ দেয় না।
এই যে ও তখন উঠোনের দড়িতে ভিজে কাপড় মেলে দিতে দিতে গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল—”কি গো মলিনা, একদিনে কত কয়লা ভাঙছ? তখন কি মলিনা ভালো করে উত্তর দিল?
দিল না।
বেজার মুখে বলল, দাসদাসীতো নেই যে তাদের পিতেসে ফেলে রাখব? মাসের কয়লা একবারেই ভেঙে তুলছি।
সুখদাও বেজার মুখে বলল, তা তো বেশ করছ, কাজের সুসার করছ। বলি একটা বুড়োমানুষ যে একটু চোখ বুজেছে সেটাও তো ভাবতে হয়।
মাধব ঘোষের প্রসঙ্গে সুখদা সব সময় বুড়োমানুষ শব্দটা ব্যবহার করে। অথচ মাধবের বয়েস মাত্র একান্ন বাহান্ন হতে পারে। তাই ওই বুড়োমানুষে কেউ সহানুভুতিতে উছলে পড়ে না। মলিনাও পড়ল না। আরও জোরে জোরে হাতুড়ি ঠুকতে ঠুকতে ভারী গলায় বলল,-”তা আর কী করা যাবে? মাস মাস ভাড়াটি ঘরে তুলতে হলে এসব উৎপাত তো একটু সইতেই হবে।
মলিনার এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবের জন্যে সুখদা বেশি কথা এগোতে পারে না। আর মলিনারা জাতে বামুন বলে মাধব ঘোষও একটু সমীহ করে। কাজেই সুখদা রণে ভঙ্গ দিল।
মলিনা সব কয়লাগুলো ভেঙে তুলল, গুঁড়োগুলো চেলে গুল পাকাবার জন্যে আলাদা করে রাখল, একেবারে বিকেলের রান্নার উনুনটা সাজিয়ে ফেলল, তারপর সাবান নিয়ে কলতলায় ঢুকে গেল।
অজিত অন্য আর সকলের থেকে ভাড়া বেশি দেয়, তাই মাধব ওদের জন্যে আলাদা একটা কলতলা করে দিয়েছে। ছাচা বেড়ার দেওয়াল, টিনের চাল, আর কর্পোরেশনকে লুকিয়ে একটা বাড়তি ট্যাপ—এই ঐশ্বর্য।