অমল পুরুষ মানুষ এবং পূর্ণ বয়স্ক, বলতে গেলে মাঝবয়সী। চোখে জল তার নিশ্চয় শোভা পায় না। তবু চার্চিলের দেহটাকে জড়িয়ে ধরে, তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে সে চোখের জল না ফেলে পারেনি। তার শোকে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কুনিয়া,নতুন কাজের ছেলেটা। বছর খানেক হল তার কাছে চাকরি করছে। পুরনো কম্বাইন্ড হ্যান্ড বীর সিং-এর বার্ষিক ছুটির মেয়াদ এক মাস থেকে ক্রমে বেড়ে প্রায় তিন মাস হয়ে ওঠায় বাধ্য হয়ে বীর সিং-এর সহকারী এবং বিকল্প রূপে মোতায়েন। ছেলেটা এর মধ্যে কাজকর্মে বেশ পটু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রান্না ও বাজারে। হেঁশেল তার হেফাজতে থাকায় সংসারের খরচ অবশ্য অমল থাকলে যা হয় না থাকলেও দেখা যায় ঠিক তাই হচ্ছে।
এ নিয়ে মৈত্রেয়ী অনেক রাগারাগি করেছে। কিন্তু অমল নিজে যা খায় কাজের লোককে তাই খাওয়ায়। বাঙালি বাড়ির মতো বাজার করবে ভালমন্দ আমিষ রাঁধবে আর খেতে পাবে ওড়িয়া ধাঁচে পখাল আর শাকভাজা বা ভাত ডালমা বা সাঁতলা, তা তো হতে পারে না। কাজেই কুনিয়া অমলের অতি অনুগত, চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলে না সর্বদা নতমস্তক, একেবারে অনুগত ভৃত্য। একতার পারিবারিক জমায়েতে দু পেগ পেটে পড়লেই ঠোঁটকাটা রণজিতের বাঁধাধরা পরিহাস-দাদার কুকুর একটা নয়, দুটো, একটা ল্যাজওয়ালা অন্যটি ল্যাজছাড়া।
সেই কুনিয়া কিনা চার্চিল মারা যাওয়ার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল। অমলের অফিসের ড্রাইভার রমেশের গাঁয়ে ওর বাড়ি, রমেশই ওকে এনেছিল, বলাবাহুল্য চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে কুনিয়ার প্রথম মাসের মাইনেটা তারই পকেটে গেছে। চার্চিল মারা যাওয়ার সময় বীর সিং দেশে, কুনিয়া একলা যাবতীয় করণীয় কর্ম করেছে। ভাগ্যিস অমলের ওড়িয়া বাঙালি অর্থাৎ ক্যারা বাড়িওয়ালা সে সময় সস্ত্রীক চাকুরে ছেলে ছেলের বউ-এর বাচ্চা সামলাতে দিল্লিতে প্রায় স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে থাকলে কি আর অমল কুনিয়া মিলে তার সাধের একফালি লনের কোণে মাটি খুঁড়ে চার্চিলকে কবর দিতে পারত? কুনিয়া আবার কোত্থেকে এক গাছা লাল জবার মালা এনে চার্চিলের গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। পরদিন রমেশকে দিয়ে লাল মুসান্ডার চারা কিনিয়ে এনে তার ওপর লাগানো হল। চার্চিলের সমাধি। অন্তত দামি গাছ হওয়ার দরুণ ভবিষ্যতে যত্ন পাবে এই আশা। দিব্যি আগ বাড়িয়ে এত সব কাজকর্ম করে তারপর কিনা ছেলেটা হাওয়া। আশ্চর্য।
রমেশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল চার্চিলের মৃত্যুর পর আশেপাশের বাড়ির কাজের লোক, মোড়ের চায়ের দোকানের কর্মচারী অফিসের পিয়ন সকলে কুনিয়াকে কী সব বুঝিয়েছে। তাদেরই বুদ্ধিতে নাকি কুনিয়া অন্য একজন পশু চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করতে গেছে চার্চিলকে ছোঁওয়ায়ির দরুণ তার কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কি না। এমন মওকা কোনও ডাক্তার ছাড়ে! ভেটও টোপ ফেলল, কুকুরটার অসুখ ছিল মারাত্মক, যেই তার সংস্পর্শে এসেছে তাকেই সাতটা ইনজেকশান দিতে হবে। ভড়কে গেলেও কুনিয়া জিজ্ঞাসা করেছে, সাহেব তো মরা কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন কতক্ষণ তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিলেন, কই তাঁর তো ইনজেকশান ওষুধ কিছু লাগছে না। ভেট খুব গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছে—সি এ পরা বঙ্গালি তাংক কিছি হবে নি। তু গরিব ওড়িয়া পিলা তু মরিবু।
ওড়িয়া বঙ্গালির মৌলিক ভেদাভেদ বিচারে বেচারা কুনিয়া সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। অতএব আর পাঁচজন ভূমিপুত্র চাকুরিক্ষেত্রে অনুরূপ সমস্যার উদয় হলেই যা করে তাই করল জীবনরক্ষার্থে গাঁয়ে চম্পট। ঢেনকানল জেলার তালচের মহকুমার মহান শক্তিধর নীলমণি ওঝার নাম কত গাঁয়ের লোকের মুখেমুখে ফেরে। কুনিয়ার মামুপুঅ ভাই (নিজের মামা নয় মায়ের পিসতুতো দাদার ছেলে) তাকে চেনে। তারই সাহায্যে কুনিয়ার নীলমণি ওঝার পদতলে আত্মসমর্পণ। বলাবাহুল্য কুনিয়ার বাবা-মা-জ্যাঠা-খুড়ো কেউ তাকে আর এমন বিপজ্জনক কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে দিচ্ছে না। দেবেও না। এখানেই চার্চিলের মৃত্যু পর্বের সমাপ্তি।
হঠাৎ অমল একেবারে একলা। চার্চিল নেই, কুনিয়া নেই। এমন কি বীর সিং-ও এবারে বার্ষিক ছুটি ভোগ করে অমলের কাছে ফিরল না। অবশ্য গত দুতিন বছর ধরেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিল, গাঁয়ে যেটুকু জমি আছে ঠিকমতো চাষ করা যাচ্ছে না, বাপ বুড়ো হয়েছে, ছেলেটা বখে যাচ্ছে কারও কথা শোনে না ইত্যাদি। চার্চিলের সঙ্গে সঙ্গে বীর সিং-এর বাপও বোধহয় মরল। অমলের শুধু আশ্চর্য লাগে বীর সিং একটা খবর পর্যন্ত দিল না। অথচ দীর্ঘ ষোলো বছব তার কাছে কাজ করেছে। অন্য কাউকে দিয়েও তো দুলাইন লেখাতে পারত। অমল বরাবব ওর সব বিপদ-আপদে সাহায্য করেছে। স্ত্রীর অসুখ, ছেলে মেযের জন্ম আঁতুড় বাড়ির চাল ছাওয়া—যাবতীয় প্রয়োজনে টাকা-ছুটি কী দেয় নি। বীর সিং-ই কি কম পেয়েছে। পোশাক-আশাক খাওয়া-দাওয়া রীতিমত মধ্যবিত্ত ঘরের মাপে। তাহলে? অমল যেহেতু চাকরিদাতা অতএব বরাবরই সেই শোষকের ভূমিকায়? এবং চাকরিজীবী বীর সিং শুধু শোষিত? মানুষের সম্পর্কের মাত্রা কি একটি? এসব প্রশ্নের কোনও জবাব পায় না। একতার সদস্যবা একবাক্যে বলে,—দুর আপনিও যেমন, কাজের লোকের সঙ্গে আবার সম্পর্ক। ওই ক্লাসের লোক ওরকমই হয়। বাংলা সিনেমায় সেই পুরাতন-ভৃত্য-কাম-অভিভাবক অর্থাৎ পরিবারের সদস্য, কবে আউটডেটেড হয়ে গেছে। সেই জন্যই তো বাংলা সিনেমা আর কেউ দেখে টেখে না।