—আপনাদের বাংলা নাটক তা হলে আর হলই না? ছায়া দেবনাথ আজ হঠাৎ গম্ভীর। আর গম্ভীর হলেই তার বাংলাটা ঠিকঠাক। অমল উত্তর দেয় না। মাথা নাড়ে। খানিক বাদে আস্তে আস্তে বলে,
—সবই কেমন বদলে গেল। একতা যেন আর একতা রইল না। আমাদের একটা শ্লোগানে ছিল আমরা থাকি বা না থাকি একতা থাকবে। প্রবাসীদের সংস্থা। সর্বদা কেউ না কেউ আসছে। আবার অন্য কেউ বা চলে যাচ্ছে। নতুন সদস্য আসে পুরনোরা বিদায় নেয়। প্রায় বলতে পার আমাদের জীবনের ছাঁচ। নতুন মানুষ আসছে, পুরনোরা চলে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে মানুষই বা কি। বলতে গেলে পরবাসী। কদিন হাসিকান্না মেলামেশা। ব্যাস খেল খতম।
-বাপরে, আপনি দেখি আবার ফিলজফি কপচান। এই না বারবার বলেন আপনি কাঠখোট্টা ব্যাঙ্কার, খালি লাভক্ষতি হিসাব বোঝেন। আদি অকৃত্রিম বাঙালের পুনরাবির্ভাব।
—সেই লাভক্ষতির অঙ্কই তো কষছি। কী পেয়েছি কী পাইনি তার হিসেব।
–আমি অত হিসাব বুঝি না। গল্পটার কী হইল বলেন। শ্যাষ কই?
–শ্যায় নয় শেষ। বলেন নয় বলুন। কত শেখাবো?
–মানলাম না হয় শেষ, বলুন। তা শেষ করবেন তো। আপনি তো লাইফের মাঝখানে আইস্যা ঠেইক্যা রইলেন। কতই বা বয়স তখন আপনার। ঘরসংসার কিছুই তো দেখি এখনও হইল না। জমিবাড়ি করসিলেন তো? আর আপনার হিরোয়িন মৈত্রেয়ী গ্যালেন কই?
অমল চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির গায়ে বাড়ি। পুরনো। সেই সময়ের নির্মাণ যখন সুস্থনগরায়ণের ধারণা ছিল না। তবু এখান ওখান থেকে সবুজ উঁকিঝুঁকি মারছে। তার মতো জন্ম কংগ্রেসীও মানে যে বামফ্রন্ট সরকার এক আধটা ভাল কাজ করেছিল যার একটা হল সামাজিক বনসৃজন, প্রকৃতি পরিষেবা। (এত শক্ত বাংলাও অমল বামফ্রন্টের কল্যাণে শিখে ফেলেছে)। চুন বালি ইট সিমেন্ট কংক্রিটের ফাঁকফোকরে অনেক ঘটাপটা করে লাগানো হয়েছিল গাছগাছালি। কিছু বেঁচেওছে।
আশ্চর্য এই বাংলার মাটি। চেয়ে চেয়ে দেখে অমল। রোজই দেখে। দিনের অধিকাংশ সময় তার এই সবুজটুকু দেখেই কাটে। কোথা থেকে, আশ্চর্য মাটির কোন গভীরে পায় সঞ্জীবনী স্পর্শ? আহা মানুষ যদি গাছ হত। বিশ্বাসভঙ্গ ঈর্ষা ক্ষোভ তিক্ততার নিরেট স্তর ভেদ করে কোন অতলে কোমলের একটু ছোঁওয়া খুঁজে নিয়ে আবার বেঁচে উঠত। বুকের ভেতর ধুক ধুক করাই তো প্রাণ নয়। একটু কোমলতার জন্য বেঁচে থাকা। পাঁচতারা হোটেলে খাওয়া, বোমকাই ঢাকাই কাঞ্জিভরম কেনা, মঞ্চে টি ভি ক্যামেরা আলোতে দাঁড়ানো—সবই অমল মৈত্রেয়ীকে দিয়েছিল। তবু মৈত্রেয়ী কেন শেষে হারিয়ে গেল? সেও কি একটু কোমলতার ছোঁওয়া চেয়েছিল? বাইরের দিকে চেয়ে দেখে বেশ সবুজ রয়েছে গাছটা, কলকাতার গাড়িঘোড়া ধুলোময়লার মধ্যেও।
-কী হইল? চুপ ক্যান? গল্পটা বলবেন তো।
–আজ থাক। আর মনে পড়ছে না।
—সে আবার কী। সংসারধর্ম করলেন কি না, জমিবাড়ি হল কি হল না, এগুলোতে মোটা কথা। এসব ভোলা যায় না কি?
-আঃ বিরক্ত কোরো না। সব ভোলা যায়। তেমন অবস্থায় পড়লে লোকে নিজের নামও ভুলে যায়। এতদিন এরকম একটা জায়গায় নার্সগিরি করছ, তোমার তো জানার কথা। কাজটাজ কর, না খালি ঐ পেশেন্টদের জীবন কাহিনী লেখ। যাও অন্য পেশেন্টদের দেখতে যাও। সব সময়ে আমার ঘরে কেন।
পরের দিন সকালে হাসি হাসি মুখে ছায়া দেবনাথ ঢোকে। নমোনমো করে প্রেসার দেখে, চেয়ার টেনে সামনে বসে।
-আচ্ছা আপনার অ্যাকটা কুকুর ছিল না? সেই যে ইংরাজদের কোন নামজাদা প্রধানমন্ত্রীর নাম দিসিলেন তারে? গ্ল্যাডস্টোন না ডিজরেলি না কি?
-ফাজলামি কোরো না। তুমি ভাল করেই জানো তার নাম ছিল চার্চিল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ চার্চিল। ভারি অসভ্য ছিল কুকুরটা। আপনারা একজাতি এক প্রাণ একতা কোরাস ধরলেই কুকর্ম করত। পার্টি বানচাল হইত। তার কথা কই আর বলেন না তো।
—তার আর কী কথা। একটা পোষা বুল ডগ আদরে গোবর হয়েছিল এই তো। খেত আর ঘুমোত, নিয়মিত দৌড়ানো বল খেলা কিছুই করাতে পারতাম না। আমার সময় কোথায়। চাকরবাকরদের জিম্মায় কি আরও জাতের কুকুর ভাল থাকে।
-ক্যান, শরীরটরির খারাপ ছিল না কি।
–তা নয়। তবে ব্যায়াম না থাকলে ও সব কুকুর ঠিক ফর্মে থাকে না।
–তবে আপনারে খুব ভালবাসত।
–হ্যাঁ, ভাল জাতের কুকুর সর্বদা ওয়ান মাস্টার ডগ। আমার কথাই শুধু শুনত, যদিও ওর সবই করত বীর সিং। আশ্চর্য, কুকুরদের মতো এত শ্রেণীসচেতন জীব মানুষও নয়। ওদের গ্রাহ্যই করত না। আমার কাছাকাছি থাকাটা তার জীবনের সব। এত বুদ্ধিমান ছিল যে কী বলব। সমস্ত বুঝত। কারা আমার আপনজন, কারা নেহাত কাজের সুত্রে আসে যায়। তাদের সঙ্গে তার ব্যবহার আমার সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী। মৈত্রেয়ী তার পুরোপুরি আপনার, যদিও সর্বদা থাকত না। তাকে যে মানতে হয় ওটা কী করে বুঝল কে জানে। যখনই আসত প্রথমেই আদর অভ্যর্থনা। যতদিন থাকত পায়ে পায়ে ঘুরত।
—দ্যাখেন। ভাষা নাই তবু ক্যামন বুঝাইতে পারে। তা কতদিন ছিল আপনার সাথে? মনে পড়ে?
হ্যাঁ, এখন মনে পড়ে। সেই ২২ শে শ্রাবণের ঝামেলার সময়েই ঘটেছিল ব্যাপারটা। অগস্টমাসের পচা গরমে না কে জানে কেন পাড়াজুড়ে কুকুরদের মড়ক লাগল। ডিসটেম্পার, মারাত্মক অসুখ, সাধারণত এক বছরের কম বয়সের কুকুরদের হয়। কিন্তু সেবার সব বয়সের কুকুরদেরই হচ্ছিল। ঘণ্টাকয়েক প্রচণ্ড কষ্ট ছটফটানি থেকে থেকে খিচুনি, ব্যাস জলজ্যান্ত প্রাণীটা খতম। বোধহয় সান্ত্বনা দিতেই ভেট, ওর ডাক্তার জানাল প্রাক্তন এক মুখ্যমন্ত্রীর পোষা স্পিৎজ কুকুরটিও গতকাল এই রোগে মারা গেছে। অর্থাৎ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী (হলেই বা প্রাক্তন) যার দাপটে কাবু, তার কাছে অমল কুমার দাস তো কোন ছার।