–চার্চিল নামে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিল বুঝি? ছায়ার সরল জিজ্ঞাসা।
—সে কি! চার্চিল কে জানো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংল্যান্ডকে রক্ষা করেছিলেন। চার্চিল না থাকলে আজ পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হত।
—তা যুদ্ধ কি আমাগো সাথে হইছিল?
–উঃ! বাংলাদেশের স্কুলে কি কিছুই পড়ানো হয় না। আমাদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ হবে কী করে! আমরা তো তখন ইংরেজদের অধীন। একটা গরিব পিছিয়ে-পড়া উপনিবেশ। আমাদের অত মুরোদ হবে কোথা থেকে? সে সময়ে পৃথিবী জুড়ে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এশিয়া আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া সর্বত্র।
ছায়ার কথাবার্তা ভাবভঙ্গিতে মনে হয় পৃথিবীটা চিরকাল ঠিক এখনকার মতো ছিল। বাংলাদেশ, জগতের সবচেয়ে মার-খাওয়া ভুখণ্ড, ভারত পাকিস্তান ইংরেজ হিন্দু পঞ্জাবি সবাই তাকে শোষণ করেছে, সবাই তার দুশমন। পৃথিবীর শুরু ১৯৪৭ সালে। তার আগে সব শূন্যশূন্য। প্রথম প্রথম অমল চেষ্টা করত বোঝাতে বাংলাদেশ পাকিস্তান সব নিয়ে ছিল ভারতবর্ষ। শুনলেই ছায়ার হাসিহাসি মুখ আর হাসিহাসি থাকেনা। কথাগুলো যেন শুনতেই পায় না। অমল আর ছায়ার মধ্যে কেমন যেন একটা দেওয়াল গজিয়ে ওঠে। তাই এখন আর ইতিহাস-টিতিহাসের সূত্র অমল টানে না। এমনভাবে কথাবার্তা বলে যেন কোনও সময়ে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের অংশ ছিল কি ছিল না তাতে কিছু যায় আসে না। নিজেকে মাঝে মাঝে বোঝায় কথাটাতো মিথ্যে নয়। ভারতবর্ষই তো নেই। সে যে দেশের নাগরিক তার নাম ইন্ডিয়া, ব্রিটিশের সৃষ্টি। তাছাড়া সে নিজে তো পাক্কা ঘটি, হান্ড্রেড পারসেন্ট। পশ্চিমবঙ্গে চোদ্দোপুরুষের ভিটে। খাস কলকাতায় তিন পুরুষ। বাবা জ্যাঠারা বর্ধমান বা হাট গোবিন্দপুরের নাম পারতপক্ষে মুখে আনতেন না। তাঁদের কাছে পরিবারের উৎপত্তি ঠাকুরদার কলকাতায় বাস অর্থাৎ ১৯১৩ সাল থেকে। তার আগে কিছু নেই। যেমন ছায়ার কাছে ১৯৪৭-এর আগে বাংলা নেই। অমলের নিজের জন্ম ১৯৪৭ সালের কাছাকাছি, আগের বছরেই, তবু প্রাক্-স্বাধীনতাযুগ শ্রুতি হয়ে তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আজও।
৪৭ সালের আগের বাস্তবতার কাছে দোতলার সবচেয়ে ভাল শোওয়ার ঘরটি। সেখানে মধ্যেখানে বিরাট পালঙ্ক। বাংলা সিরিয়ালে ঠিক যেমনটি দেখা যায়, চকচকে পালিশ কালো আবলুস কাঠের। প্যাঁচানো প্যাঁচানো খোদাই করা কাজের পায়াছত্রি। মাথার দিকটা কাঠের জালি, মুকুটের আকৃতি। শক্ত ছোবড়ার তোষক। পরিপাটি টানটান সাদা ধবধবে চাদর। মাঝখানে একটার ওপর একটা সাজানো দুটি শক্ত বালিশ। তাতে আঁট করে পরানো ফ্রিল দেওয়া ধবধবে ওয়াড়। মস্ত মোটা সাদা পাশ বালিশ। খাটের ধারে আটকোনা টেবিল। তার পাশে একটি বড় হেলান দেওয়া নিচু চেয়ার। সেই কালো আবলুস কাঠের। গোল গোল হাতল পায়া। বেতেবোনা পিঠে হেলান দিয়ে পা মেলে বসে ঠাকুরদা বিষ্ণুপদ দাস। পরনে লুঙ্গির মতো করে ধুতি, গায়ে ফতুয়া। দুই ধোপদুরস্ত। হাতে গড়গড়ার নল, মাঝে মাঝে টানছে। অমলের স্মৃতিতে ব্রিটিশ ভারতের রেশ।
তার তখন বয়স কত? বছর ছয়েক বোধহয়। আধ বোজা চোখ খুলে ঠাকুরদা অমলকে বলছেন,
—ওই দেখো, সামনের ছবিটা দেখেছো? সামনের দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মস্ত ছবি। ধূসর বাদামি রং বহু পুরনো। এক মেমসাহেব দাঁড়িয়ে। পা পর্যন্ত ঝোলা পোশাক, ভারী মুখ, মাথায় বিলিতি ডিজাইনের মণিমাণিক্যের মুকুট। ঠাকুরদা ভক্তিভরে বলতেন,
–বুঝলে দাদুভাই, ইনি ছিলেন আমাদের আসল মালিক, কুইন ভিক্টোরিয়া। সে সময় ছিল আলাদা। দেশে তখন আইনশৃঙ্খলা ছিল, সভ্যতা ছিল। একজন সাহেব পুলিশ অফিসার কী বলতেন জানো? কলকাতা শহরের রাস্তায় একটি অল্পবয়সি মেয়ে সর্বাঙ্গে গয়না পরে রাত বারোটার সময় একলা হেঁটে গেলেও কেউ তার মাথার চুলটি ছুঁতে পারে না। কারণ ব্রিটিশ এমপায়ার তাকে রক্ষা করছে। এই ছিল আমাদের রাজার জাত। ইস্কুল কলেজে পড়াশোনা হত। একটু পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি। আমরা বাঙালিরা কোথায় না চাকরি করেছি। সেই রেঙ্গুন থেকে কোয়েটা। ম্যাপ দেখেছো? কী বিরাট ক্ষেত্র ছিল আমাদের। ব্যবসাই বা কি কম করেছি? স্যার রাজেনের স্টিলপ্ল্যান্ট থেকে শুরু করে বেঙ্গল কেমিক্যালস, বেঙ্গল পটারিজ, ক্যালকাটা কেমিক্যালস, সেনর্যালে, ডাকব্যাক কত নাম করব? জাহাজের ব্যবসা মাইনিং কি না করেছি আমরা। এই কলকাতা শহরে প্রাসাদের মতো বাড়ি ছিল সব বাঙালিদের। শুধু কলকাতা কেন পশ্চিমেই বা কম কী? এলাহাবাদ-লখনউ, বেনারস, মজঃফরপুর, ভাগলপুর, রাঁচি, জামশেদপুর, মুঙ্গের, দেওঘর সর্বত্র। বৃহৎ বঙ্গ। সেই সময় ছিল আমাদের স্বর্ণযুগ। মেধা আর কর্মক্ষমতা এই দুটি জিনিস সম্বল করে আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম, সসম্মানে বেঁচেছিলাম। আর এমন হতচ্ছাড়া জাত আমরা যে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। সব ভেঙেচুরে নষ্ট, দেশটা শ্মশান আর নেত্য করছে সব ভূত-প্রেতের দল।
এই সব ভূত-প্রেতের অন্যতম ছিলেন অমলের পূজ্যপাদ পিতৃদেব স্বৰ্গত হরিচরণ দাস বি এ বি এল। বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতির পুরুষানুক্রমিক স্থাপত্যকীর্তির ইতিহাসে তার নিজস্ব অবদান সদর দরজার কোলাপসিবল গেটটি। কারণ গেট দিয়ে ঢুকে প্রথম বাঁদিকের ঘরখানা তারই চেম্বার, কর্মস্থান অর্থাৎ জীবনের কেন্দ্র। ঘরের মাঝখানে একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও গদিআঁটা চেয়ার। সামনে ও পাশে মক্কেলদের জন্য নির্দিষ্ট গোটা কয়েক হাতলওয়ালা চেয়ার, গদিছাড়া। পিছনের দেওয়ালে আয়তক্ষেত্রটি মেঝে থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত আইনের বই ও পুরনো কেরেকর্ডে ঠাসা। পাশে চিলতে ঘরে জুনিয়র মোহন বিশ্বাস ও পি এ কালীবাবু। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা হাতে ও খটাখট টাইপমেশিনে চিঠিপত্র দলিল দস্তাবেজ মুসাবিদাবা চূড়ান্ত চলছে। ওকালতিতে মন্দ পসার ছিলনাহরিচরণ দাস, বি এ বি এল-এর। এমন সময় ধরল স্বদেশি ভূতে। চিত্তরঞ্জন দাশের দৃষ্টান্তেঅনুপ্রাণিত হয়ে ভিড়লেন কংগ্রেসে। অতঃপর পিছনের দেওয়ালে বইপত্রে জমতে লাগল ধুলো। সামনের দেওয়ালে দরজার দুদিকে শোভা পেল দুটি দুটি চারটি ছবি–চিত্তরঞ্জন,সুভাষচন্দ্র, গাঁধী, নেহরু। মাঝখানে অর্থাৎ দরজাব ওপরে টাঙানো হল ফ্রেমে বাঁধাই অমলের দিদির হাতে চটের ওপরে ক্রসস্টিচে লতানো হরফে গেরুয়া সাদা সবুজে ফোঁটানো মন্ত্র একজাতি এক প্রাণ একতা। অমলের সারা শৈশব ওই এক মন্ত্রজপ। কারণ ততদিনে স্বাধীন ইন্ডিয়ায় গদিতে আসীন কংগ্রেসের মাহাত্ম্য বুঝেছেন জ্যাঠা মামা পিসে মেসো সবাই এবং হরিচরণের দুরদৃষ্টি পরিবারের সর্বজনস্বীকৃত। এক জাতি এক প্রাণ একতার গৌরব তার সমস্ত পরিবেশে ব্যাপ্ত। স্কুলে নিজের ও সব-তুতো দাদাদের মার্চড্রিল পাড়ার নেতাজি ব্যায়ামাগারে তাসা পার্টির সঙ্গে সমবেত সঙ্গীত। একতার শিকড় গেড়ে বসে আছে অমলের চেতনার গভীরে। হয়তো বা তার জীবনেও।