—যা যা আপনার কাছে শুনি, প্রথমে আমার স্পেশ্যাল সর্টহ্যান্ডে মানে যারে কই ছায়াভাষা তাতে লিইখ্যা লই। বাসায় যাইয়া ভাল কইর্যা লিখি। লিখতে লিখতে আমার বাংলাটা একটু ভদ্র হইতাসে না?
–না, তোমার বাংলা কিছুই হচ্ছে না। আর এত কাগজ নষ্ট করো কেন? জানো কাগজ বানাতে গাছ নষ্ট হয়? যদি লেখালেখি করতেই হয়–যদিও কেন করবে তার কোনও মাথামুণ্ডু পাই না–তবে এক কাজ কর। একটা স্লেট আর কটা পেনসিল কিনে এনো। আজ যা লিখবে কাল তা মুছে ফেলবে। আবার লিখবে আবার মুছবে। একটা স্লেটেই শুধু আমার কেন এই লুম্বিনী ক্লিনিকের (না পার্ক না বন, যাকগে) সব রোগীর জীবনী এঁটে যাবে।
–কী যে বলেন। লেখাটা যদি মুইছা ফেলি তবে পড়বেটা কে? কেউ তো দ্যাখতেই পারব না। সঙ্গে সঙ্গে শ্যাষ হইয়া যাইব।
–কেন তুমি, তুমি তো শুনছ জানছ পড়ছ। ওই একজন জানলেই হবে। তুমি কি মনে করো কাগজে লিখে রাখলেই সকলে জানতে পারে? পড়তে পারে? চিরকাল থাকে? এই বাংলাতেই তো কত শত শত লোক কত কী লিখে গেছে। তাদের কজনের নাম জানো? কটা লেখা পড়? যখন লেখা হয়েছে তখনই বা কজন পড়েছে?
—তা যা বলসেন। আমার তো পড়াশুনার বড় ইচ্ছা, কিন্তু সময় নাই। সময় যদিই বা পাই বইটইগুলা বড় শক্ত লাগে। আপনাগো বাংলা এত ভিন্ন। জানেন তো আপনাগো সংহতি কম্পুটার যারে কয় কম্পদেবতা তার আশীর্বাদে সব আঞ্চলিক ভাষায় শতকরা তিরিশভাগ হিন্দি আইস্যা গেসে? আরও আসব। মডেল হইসে টিভি চ্যানেলগুলা। দ্যাখেন তো সরকারি দূরদর্শনে শতকরা পঁচাত্তরভাগ অনুষ্ঠান কার্যক্রম হিন্দিতে।
—তাহলে তুমিই দেখো আর এক জেনারেশন পরে বাঙালি ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্ৰই পড়তে পারবেনা। বঙ্কিমের তো প্রশ্নই উঠছেনা। যে ভাষার, যে সাহিত্যের এই হচ্ছে অবস্থা সেখানে অমলকুমার দাসের মতো এক হরিদাস পালের জীবনী লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কী?
—মানে আর কী। সবই হইতাসে ছায়ার ছায়াবাজি। খিলখিল করে হেসে গড়ায় ছায়া। মেয়েটার সব কিছুতে হাসি। লঘুগুরু জ্ঞান নেই। অমল গম্ভীর হয়।
—ঠিকই বলেছ ছায়াবাজিই বটে। সবই অনিশ্চিত, মায়ামাত্র। যখনকার ঘটনা শুধু সেই মুহূর্তেরই অস্তিত্ব। আমি বলার জন্য বলি, তুমি লেখার জন্য লেখো। তার বেশি কিছু নয়। ছায়ার মুখে এখন আর হাসি নেই।
—আপনি মানুষটা বড় অদ্ভুত। এত বড় বড় কথা আপনার মনে। কিন্তু সাধারণ কথাটা নাই। জন্ম-শিক্ষাদীক্ষাকাজকর্ম পরপর বলবেন তো। কাহিনী মানেই তো নায়ক বানায়িকার জন্ম থেকে তারপর কী হইল।
—দেখো ওইটি একেবারে চলবে না। তারপর কী-হলর জুলুম। আমি কি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি নাকি। আমার যখন যেমন যা যতটুকু মনে আসে ঠিক তেমন ঠিক ততটুকু বলব। শুনতে হয় শোনো, লিখতে ইচ্ছে হয় তো লেখো। নইলে থাক তোমার ছায়াবাজি।
.
হ্যাঁ থাক। অত তারপর কী হল তারপর কী হল করার আছেটাই বা কী। সব তারপর এর শেষ তো এখানে, তিনশো দুই নম্বর ঘর, লুম্বিনী ক্লিনিক না পার্ক না হোম না কি বন। অর্ধেক পুরুষ। আধমরা মানুষ। এটা নেই সেটা নেই। শুধু বুকের কাছে ধুক ধুক ধুক।
২. ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯
বাস্তবের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক সমস্যামূলক। উচ্চশিক্ষিত, দীর্ঘকাল উচ্চপদে চাকরি, অকৃতদার। শারীরিক অসুস্থতা ও কয়েকটা অস্ত্রোপচারের ইতিহাস আছে। বেশ কিছুদিন ক্লিনিকের বাসিন্দা। কোনও মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদানের আগ্রহ নেই। গত তিনমাসে বহুর কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করেছি। রোগী হয় নিরুত্তর নয়তো ক্রুদ্ধ। পরিবারের কেউ দেখতে এলে উত্তেজনা, বিরুদ্ধ মনোভাব বেড়ে যায়।
আমি আজকাল একটি বাংলাদেশি নার্স সেজে থাকি। এই ভূমিকাটি রোগীর কাছে যেন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। তাছাড়া সম্পূর্ণ মিথ্যেও নয়। আমি বাংলাদেশের মেয়ে, আমার কাজ মানসিক রোগ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। উদ্দেশ্য মানুষের যন্ত্রণার উপশম। গবেষণা শুধু তো ডিগ্রির জন্য নয়। এক অর্থে সেবা।
মনে হয় কথা বলতে রাজি করাতে পেরেছি। ছেলেবেলার স্মৃতি মানসিক রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমিও ভদ্রলোককে নিজের জীবনকাহিনী বলতে উৎসাহ দিই। শৈশব কৈশোরের দিনগুলির জন্য পরিণত বয়সে সাধারণত যে স্মৃতিমেদুরতা থাকে তার লক্ষণ রোগীর মধ্যে দেখি না। এদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।
সময়চেতনার এমন মারাত্মক ঘাটতি বাস্তবের সঙ্গে যোগস্থাপনে অনীহাই প্রমাণ করে। তবে কথা বলতে ইচ্ছেটা উন্নতির প্রথম সোপান। আত্মপ্রকাশ থেকে আত্মসমীক্ষায় যাওয়া অসম্ভব নয়। হয়তো টুকরো টুকরো খাপছাড়া স্মৃতির একত্র সমাবেশে পরে একটা সামঞ্জস্য বা অর্থ পাওয়া যাবে। মানুষের মন চিররহস্যময়, বিজ্ঞানপ্রদত্ত কেমিক্যাল বা ওষুধ তাকে সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারে না।
অমলের মনের মধ্যে কতকগুলো প্রশ্ন বারেবারে আসে। উত্তর জোটে না। চার্চিল কোথায়। ভুবনেশ্বরে কলকাতার শুভ নাট্যগোষ্ঠীকে আনা গেল না কেন, রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা কী হল। প্রশ্নগুলো খালি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় ঘুরপাক খায়। চার্চিলশুভবি। রবিশুভচার্চিল। শুভচার্চিলরবি। যেন একটা ধাঁধা। তবে চার্চিল যে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল নয় সেটা ঠিক মনে আছে।