বিষ্ণুপদ চললেন ছোটবাবুর কাছে। ছোটবাবু অর্থাৎ ছোট তরফের জমিদার চন্দ্রমোহন। গাঁয়ের যুবসমাজের হিরো। তার নেশা কলকাতা। অর্থাৎ গান বাজনা নাটক সমাজসংস্কার শিক্ষাবিস্তার। অর্থাৎবঙ্গে যে নবজাগরণ ঘটেছে বলে শোনা যায় তিনি তারই প্রতিভূ। তার জমিদারিতে আগমন মানে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা, দীনবন্ধু বা মাইকেলের নাটক থেকে পাঠ। কখনও ভাল যাত্রা। গাঁ-সুদ্ধ বালক কিশোর যুবকের মতো বিষ্ণুপদও ছোটবাবুর একান্ত ভক্ত অনুগামী। এখন পরিবার আত্মীয়বর্গের সঙ্গে বিরোধে ছোটবাবুর শরণাপন্ন হন বিষ্ণুপদ। প্রার্থনা, দুই তরফের স্বৰ্গত পিতামহের নামে প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ চাই। জমিদার মাত্রেই মুখ অত্যাচারী মাতাল, চাষি বউ মেয়ের সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারী দানব হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে কিন্তু সেরকম কিছুই দেখা গেল না।
বিষ্ণুপদ দাস ছোটবাবুর দাক্ষিণ্যে শুধু বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের সুবিধাই লাভ করলেন না তার ক্রমাগত উৎসাহ ও সাহায্যে (কিরে বিষ্ণু বইটই পাচ্ছিস? নে দুটো পয়সা বা আয় আমার লাইব্রেরিতে ছুটির দিনে বসে বই পড়) স্কুলের শেষ ধাপটিও অতিক্রম করে গেলেন। আলোকপ্রাপ্ত ধনীর আনুকূল্যে ও ব্যক্তিগত উদ্যমের মিলিত ধাক্কায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন সনাতন গ্রামীণ হিন্দু জীবিকা জীবনচর্যা ও আবহ থেকে। পাড়ি দিলেন কলকাতা, যেখানে ইতিমধ্যে জমিদারির আয় মূলধন করে কাগজের ব্যবসায় নেমেছেন ছোটবাবু। সাহেবসুবো কারবারিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় চলছে। তার সুপারিশেদু-চারদিন হাঁটাহাঁটির পর ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড ম্যাকলয়েড কোম্পানিতে বিষ্ণুচরণের চাকরি জুটে গেল। সাহেব পুঁজিপতিরা ঔপনিবেশিক শোষক, কর্মীদের কাছ থেকে তাদের দাবি নিষ্ঠা ও শ্রম। পরিশ্রমী বিষ্ণুপদর ধীরে ধীরে উন্নতি হল। না, কুঁড়েঘর থেকে মর্মর প্রাসাদ পর্যন্ত নয়। তিরিশ বছর বিশ্বস্ত আন্তরিক কার্যদক্ষতায় মাঝারি গোছের সুপারভাইজারি র্যাংকে উঠলেন। শ্রমিক চাষার বংশে চাষার পরিবারে জন্মে বিষ্ণুপদ দুপাতা ইংরেজি পড়ে ইংরেজদের গোলামী করে হলেন ভদ্রলোক। এবং দুপয়সা হাতে আসতে মুখসুখ গরিব বাপমা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে সকলের ছিছিক্কারে কানে আঙুল দিয়ে একগলা ঘোমটা টানা অক্ষরজ্ঞানহীন স্ত্রীকে এনে তুললেন কলকাতার ভাড়া বাড়িতে।
এসব কথা কি ছায়াকে বলা যায়। বাঙাল মেয়ে কিছুই বোঝে না হয়তো বলে বসবে বলেন কি আপনার পূর্বপুরুষ ছিল চাষা! বা আপনার ঠাকুরদা মানুষটা মোটেই সুবিধার ছিলেন না। অ্যাকনম্বরের নিমক হারাম। বাপ মা ভাইবোনকে দ্যাখলেন না। শুধু নিজেরে লইয়া থাকলেন। ছি ছি। কিন্তু আমি বুঝি ঠাকুরদা কেন চোখ কান বুজে গা থেকে পালিয়ে গেলেন। দশজনের পরিবারে যদি দুজন তলায় পড়ে থাকে বাকি আটজন তাদের টেনে ওপরে তুলতে পারে। কিন্তু যদি একজনই মাত্র ওপরে, নজনই তলায়, তখন সেই একজন পালাতে বাধ্য, নইলে নজনের টানে সেও তলাতে পড়ে যাবে। অতএব ছায়াকে শুধু বলি,
–কলকাতা আমার দেশ। আমাদের তিন পুরুষের বাস এই শহরে।
.
বিবেকানন্দ রোড আর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ের কাছে বাঁ-হাতি গলি। তার দুটো বাড়ি ছাড়িয়েই রকওয়ালা আড়াইতলা বাড়িটা। লালচে গোলাপি রং, জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রীতিতে গড়া। নতুন পুরনো পাশাপাশি উপর-নিচ সহাবস্থান। তাদের তিন পুরুষের বাস। সামনের সদর দরজার ওপরের দেওয়ালে আধখানা চাঁদ আকৃতির কারুকার্য বজলক্ষ্মী স্মৃতি নামের তলায় সন ১৯১০। বাড়ির আদত মালিক যিনি বাড়িটি তৈরি করেছিলেন তার স্ত্রীর নাম ছিল বঙ্গলক্ষ্মী। ভদ্রমহিলার জন্ম সেই সময় যখন আঞ্চলিকতাবাদ কথাটা অভিধানে ঢোকেনি, যখন বাঙালির দেশ ছিল বাংলা, গণিতের কোনও যাদুমন্ত্রে সপ্তকোটি সন্তান চল্লিশ কোটি ভারতীয়তে পরিণত হয়নি। অর্থাৎ যখন সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাতৃভূমি ছিল বাঞ্ছিত ভূমি। সেই সময়। তবে মালিক ভদ্রলোক নিজে শ্বশুরের মতো দেশপ্রেমিক ছিলেন কিনা জানা না গেলেও পত্নী-প্রেমিক যে ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অকালে মৃত স্ত্রীর স্মৃতিতে নামকরণ করলেন সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থে তৈরি ইট কাঠ চুন বালি সিমেন্টের নির্মাণটির।
প্রথম কবছর বিষ্ণুপদ দাস এ বাড়িতে ছিলেন একতলায় ভাড়াটে। অপুত্রক বাড়িওয়ালার মৃত্যুর পর হলেন গোটা বাড়ির মালিক। প্রবাসী বিবাহিতা দুই মেয়ের কাছ থেকে বলতে গেলে জলের দামেই কিনেছিলেন বাড়িটা। তারপর নিজের ক্রমবর্ধমান পরিবারের প্রয়োজনে যতটুকু যে দিকে বাড়ানো যায় বাড়িয়ে ফেললেন। ছেলেদের অর্থাৎ অমলের বাবাদের যুগের যার যেমন শখ ও ট্যাকের জোর সেই অনুযায়ী অদলবদল নবীকরণ। বাড়িটার জগাখিচুড়ি চেহারা তাদের তিনপুরুষের তিনটি সময়ের সাক্ষ্য। শুধু পুরনো নামটার পরিবর্তন হয়নি। সেই বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতি। আদি ও অকৃত্রিম।
ছায়া দেবনাথ খসখস করে লিখে চলেছে। দেখে দেখে একসময় অমল বলে,
–তুমি কি যা বলি সব কথা লেখো না কি?
–বাঃ! লিখুম না! বললাম তো আমি আপনার জীবনী লিখতাসি। এই দ্যাখেন। ব্যাগের তলা থেকে এক তাড়া পুরনো খাতা ছেঁড়া রুলটানা কাগজ দেখায়।