—জানেন অমলবাবু, আপনারে আমি একটা নাম দিলাম,রামগডুর। সেই যে রামগড়ুরের ছানা হাসতে তাদের মানা। আপনি যা গম্ভীর। রামগডুরের ছানার বাপ। অমনি অমলও একটু ফিক করে হেসে ফেলেছিল।
ছায়া দেবনাথের হাসি আর কথার সঙ্গে পাল্লা দেয় তার কৌতূহল। সকলের সব কিছুতে তার নাকগলানো চাই। তার কাছে শুনে শুনে এখন অমলের অনেক ডাক্তার নার্স রোগীর জীবনচরিত জানা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি কাহিনীর আগে বলে নেবে,
–জানেন, এটা কিন্তু আমার বলা উচিত নয়, অন্য পেমেন্টের অসুখের কথা বলা মানা জানেন তো? শুধু আপনারে বলসি। অমলের বিশ্বাস প্রত্যেককেই ছায়া একই ভূমিকা দেয়। অবশেষে একদিন এল সেই অবধারিত প্রশ্ন।
–আচ্ছা অমলবাবু, আপনার দ্যাশ, মানে দেশ কোথায়?
–কলকাতা।
–তাহলে তো আপনার দ্যাশ বলতে কিছুই নাই।
—সে আবার কী। কলকাতা কিছুই নেই।
–কলকাতা কি আর আছে, কবে উইঠ্যা গেসে। যেন জোর করে বেজার মুখ করে ছায়া। ধড়মড় করে উঠে বসে অমল।
-মানে? একটা জলজ্যান্ত এত বড় শহর উঠে গেছে মানে?
-কেন? এই স্টেটের কত কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য উইঠ্যা গেসে, উইঠ্যা গেসে টালিগঞ্জের বাংলা ফিল্ম। কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের বাজার। তবে শহরটা উইঠ্যা যাইব না ক্যান?
অমলের কেমন হাত-পা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। চারিদিকে যেন সব অজানা অপরিচিত। ধমক লাগায়।
–বাজে কথা রাখো। খালি ফাজলামি। আমার জন্মস্থান কলকাতা। কলকাতা বরাবর কলকাতা। মানুষ মরে যায়। সময় বদলায়, কিন্তু জায়গা, মাটি এক থাকে বুঝলে। সেটা অদৃশ্য হতে পারে না। কলকাতা আমার পায়ের তলার মাটি। কলকাতা…..
—আরে, চটতাসেন ক্যান। আপনি তো তাজ্জব মানুষ। মনে নাই? সেই যে বোম্বাই হইল মুম্বাই, মাদ্রাজ হইল চেন্নাই। আর গৌহাটি তো কবেই গুয়াহাটি। আর সকলে ছি-ছি করতে লাগল। বাঙ্গালি লোক আভি তক আংরেজ কা গুলাম। আমি তখন কত ছোট, মাইনর স্কুলে পড়ি। বাবা একদিন বাসায় আইস্যা বলল, ইন্ডিয়াতে সকলে কী বলতাসে জানস? ইংরাজরা আসার আগে যা ছিল তাই আমাগো নিজস্ব, তাই ঠিক। বিদেশির চিহ্ন মুইছা ফ্যালো। সেই অবস্থায়, সেই সময়ে ফিইর্যা চলল। জব্বর গণ্ডগোল লাগসে ওয়েস্ট ব্যাংগলে। কইলকাতা আসিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একনম্বর শহর। ইংরাজি চক্রান্ত সেইখানে সবচাইতে বেশি। দ্যাখনা,সুতানুটি, গোবিন্দপুর দুইটারে বেমালুম বাইদ দিয়া খালি কলিকাতা, ক্যালকাটা, ক্যান রে অ্যাকচোখোমি? আপনার কি কিসুই মনে পড়ে না? কত সোরগোল, রোজ ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের সভা। মিছিলে কদিন রাস্তাঘাট এমন জ্যাম হইল যে লোকে আর বাড়ি ফিরতে পারে না। আপিসকাছারিতে রইয়া গেল। কাজকর্ম বন্ধ। শ্যাষে সিনথেসিস নামে কম্পুটার সমাধান বাতলাইল, সুতানুটির সু, গোবিন্দপুরের গো আর কলিকাতার ক লইয়া টুয়েন্টিফাস্ট সেনচুরিতে এ শহরের নাম হইল খাঁটি দিশি সুগোক। আর সাথে সাথে ওয়েস্টটা কাইটা রইল শুধু ব্যাংগল। বাংলা বানান সংস্কারের পর তার নতুন রূপ হইল বংগো। ঠিক কংগোর সঙ্গে ম্যালে। শুধু তো ন্যাশনাল হইলে চলব না ইন্টারন্যাশনাল হইতে হইব। এসব নিয়া কত কী হইয়া গেল আর আপনার কিছুই মনে নাই।
ছায়া দেবনাথ যখন একটানা কথা বলে তখন বাংলাদেশ বেতার আর বিক্রমপুরের ডোমসার গাঁ আলাদা থাকে না। মিলেমিশে ছায়াভাষা। শুনে শুনে অমলের আর এখন ততটা কানে লাগেনা কিন্তু সুগোক কথাটা কি সত্যি অমল কখনও শুনেছে? কই একেবারে তো মনে পড়ে না। তবে মেয়েটা যখন এত করে বলছে তখন হবেও বা।
—আমার কথাটার জবাব কই? আপনার দ্যাশ বললেন কইলকাতা। তা সেই আগের নামটাই না হয় ধরলাম। কিন্তু শহর কারো দ্যাশ হয় নাকি। আদি বাস কোথায় ছিল। কোন্ জেলায় কোন্ গ্রামে চোদ্দোপুরুষের ভিটা সেটা বলবেন তো?
হ্যাঁ, গাঁ একটা ছিল বটে। জেলা বর্ধমান, মহকুমা সদর গ্রামের নাম হাট গোবিন্দপুর। তবে যাতায়াত নেই বহুঙ্কাল। নামটামও পারতপক্ষে কেউ করে না। সেই কবে কোকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পাদে ঠাকুরদার বাবা বাস করতেন চোদ্দোপুরুষের ভিটেয়, নিজে হাতে জমিতে লাঙল চষতেন। যেমন বাস করেছেন তার বাবা, তাঁর বাবা ও ঊর্ধ্বতন কত পুরুষ। বংশানুক্রমিক বসবাস। বংশানুক্রমিক কায়িক শ্রম এবং বংশানুক্রমিক দারিদ্র, অসহায় বিলাপ। দুই কানেতে টান দুদিক থেকে। ব্রাহ্মণ জমিদারের প্রাপ্য খাজনা, সোনার বেনে মহাজনের প্রাপ্য সুদ–অসুখবিসুখ, বিয়েথাওয়া শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি দায়বেদায়ে নেওয়া ধারের বোঝ। পাঁচজনের দেখাদেখি ঠাকুরদার বাপ কানুচরণের চোখ খুলল। একটু দলিল দস্তাবেজ পড়তে পারা নাম সই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ জানা ব্যস, জমিদার মহাজন দুই হ্যাচকা টান থেকে নিষ্কৃতি। তাই সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিষ্ণুপদকে পাঠানো হল পাঠশালায়। আধুনিক সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষালাভ প্রায়ই বিঘ্নিত। বিষ্ণুপদর পাঠশালাছুট অর্থাৎ ড্রপ আউট হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু বাস্তব বড় গোলমেলে সব ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বের আধিপত্য খাটে না। বালক বিষ্ণুপদ বংশের প্রথম পড়ুয়া, পাঠশালার পাঠক্রম শেষ করে ফেললেন। অতঃপর বাপদাদার সঙ্গে লাঙল ধরার সময়। ইতিমধ্যে কবছর জ্যাঠা-কাকা জ্ঞাতিকুটুম্বের বিদ্রূপ শোনা হয়ে গেছে। চাষা ছেলে নামতা শিখে নাম সই করে কি জুড়িগাড়ি হাঁকাবে! পণ্ডিতমশাইও কতবার বলেছেন কলিকাল কি আর সাধে বলে। ক অক্ষর যাদের গোমাংস সেইসব চাষাভুষোদের বিদ্যাদান করতে হচ্ছে। ইংরেজ রাজত্বে জাতধর্ম আর রইল না। সব মিলিয়ে বিষ্ণুপদ দাসের একটিই মনস্কামনা, তিনি লাঙল ছোঁবেন না, লেখাপড়া করবেন। এবারে ধিক্কারে জ্যাঠা-কাকার সঙ্গে বাবা দাদা মেসো পিসের যোগদান।