—আঃ কী করছ কি। বিরক্ত হয় অমল।
—যাক বাবা, শুনছেন তাহলে। হ্যাঁ, বলছিলাম রুগী তো বিশ্রাম করে। ফ্লোর সিস্টার বকবক শুনলেই খইচ্যা যায়। কী করি। কিছু কাগজ রাখি ব্যাগের মধ্যে। প্যাটের মধ্যে কথা জইম্যা যখন ফুইল্যা ঢাক হইয়া যায় এক একটা পাতা বাইর করি আর হাবিজাবি লিখি।
—ও।
মেয়েটা বড্ড ফালতু কথা বলে। নতুন এসেছে বোধহয়। কথায় বাঙাল টান প্রকট। এখন তো প্রতিবেশী বিদেশি স্বদেশি রাজ্য থেকেই নার্স আমদানি হয়। এ রাজ্যের মেয়েরা। গেল কই? তাদের বোধহয় আর চাকরি-বাকরির দরকার নেই। আহা দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি। কে যেন লিখেছিল? মনে পড়ে না।
–জানেন অমলবাবু আমার বড় ইচ্ছা লেখালিখি করি। কিন্তু বাপ পড়াইতে পারল না। তাই এই লাইনে আইলাম।
–লিখতে গেলে পড়তে হয় বুঝি? অমল হঠাৎ প্রশ্ন করে।
–এইটা একটা জব্বর কথা কইসেন, কলকল করে ওঠে ছায়া দেবনাথ।
—আসলে কী জানেন, আমি ল্যাখতে চাই কিন্তু কী লিখুম? আমার তো এই ছাব্বিশ বৎসর বয়স, কীই বা দ্যাখসি।
—শোনো,তুমি আগে বাংলাটা ঠিক করে বলার চেষ্টা করে তোকইসেননয়,বলেছেন। ল্যাখতে নয়, লিখতে। লিখুম নয়, লিখব। ছাব্বিশ বৎসর বয়স নয়। ছাব্বিশ বছর বয়েস। দ্যাখসি নয়, দেখেছি। এতকথা অমল একসঙ্গে আগে কবে বলেছে?
বাঃ আপনি দেখি আমারে বাংলাদেশ বেতারের বাংলা শিখাইতে পারেন। একটা কাজ করবেন? আপনার লাইফ হিস্ট্রিটা আমারে বলেন। আর আমি লিখি। আপনি কত দ্যাশ, মানে, দেশ ঘুরসেন। বড় চাকরি করত্যান। কত মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সম্পর্ক হইসে। আমার তো কিছুই অভিজ্ঞতা হয় নাই। দেখি নাই কিছুই। কিন্তু আমার লিখতে ইচ্ছা আসে আপনার নাই। আপনি কইয়া যাবেন আর শুইন্যা শুইন্যা, থুরি, শুনে শুনে আমি লিখে যাব।
–না না আমার দ্বারা অত বলাটলা হবে না। বকবক করা আমার পোষায় না। আর তুমি লিখবে কী? তোমার তো বাংলাই ঠিক নেই।
—দেখেন অমলবাবু, আমার বাংলা তো তবু এক পদের বাংলা। আপনাদের দ্যাশ ইন্ডিয়াতে বাংলার কী অবস্থা? একটা কথা বাংলা তো তিনটা হিন্দি দুইটা ইংরেজি। আপনাদের বাংলা তো একটা খিচুড়ি। একবার রাস্তাঘাটে ব্যারাইয়া দেখেন না। ট্রানজিসটর অ্যাকটা দিই, শুনবেন? টিভি তো আপনি দ্যাখতে চান না। কত ঘরে ছোট টিভি আসে। যান গিয়া দুইটা বাংলা সিরিয়াল দ্যাখেন। তখন আমার বাঙ্গাল টান নিয়া এত কচকচানি বন্ধ হইয়া যাইব। যাক বাংলা ভাষার কথা রাখেন। আপনার লাইফ হিস্ট্রিটা বলবেন তো?
-আমি কি একটা অসাধারণ মানুষ যে আমার বলার মতো একটা হিস্ট্রি থাকবে। যাও যাও বকবক কোরো না। মাথাটা ধরে গেল।
-রাগ করেন ক্যান। আসেন। ন্যান জল খান। জল গড়িয়ে দেয় প্লাস্টিকের জগ থেকে ছায়া।
–না থাক। তুমি এখন যাও তো। আমাকে একলা থাকতে দাও।
.
লাইফ হিস্ট্রি। আমার আবার লাইফ তার আবার হিস্ট্রি। আমি কে? কেউ না। পুরো মানুষই তো নই। যে সব যন্ত্রপাতি কলকজায় একজন মানুষের শরীর জীবনের রাস্তাটা দিয়ে চলে তার অর্ধেকই তো কেটেকুটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি যা আছে তা এমন ঝরঝরে যে হ্যান্ডেল মেরে মেরে স্টার্ট করতে হয়। প্রতিদিন দুবেলা কতগুলো বড়ি খাই আমি যাকে ডাক্তার নার্স বেয়ারা সকলে হাসিহাসি মুখে রোজ বলে আপনি খুব ভাল আছেন। এদের কথার কোনও মানে নেই। কোনও মানুষেরই কথার কোনও মানে হয় না। সেই যে মৈত্রেয়ী আমাকে বলে গেল শরীরটার যত্ন নিও। ভাল থেকো। কোনও মানে ছিল কী? আমি সেই থেকে কারোর সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেই যাই না।
.
বাঙালের গোঁ বলে কথা। সমানে লেগে থাকে ছায়া দেবনাথ, যার আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুর সাব-ডিভিশনের ডোমসার গ্রামে অধুনা কাগজ-কলমে মুর্শিদাবাদ। শেষমেষ কথা বলতে বাধ্য হয় অমল। মেয়েটা একেবারে এঁটুলি, ছাড়েই না। গায়ের চামড়াও মোটা। ধমক দিলেও হাসে। বড় জোর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুঘণ্টা পর আবার হাসিমুখে হাজির। শ্যামলা রং, ছোটখাটো পাতলা, সামনে দাঁত দুটো উঁচু। বিয়ে হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। তার ওপরে অতি দুঃস্থ পরিবার এবং অন্য দুঃস্থ পরিবারের মতো পুষ্যি অনেক। অথচ সে সব নিয়ে মেয়েটার মন খারাপ তো দূরের কথা কোনও মাথাব্যথাই নেই। সর্বদা হাসির ছরা, কলকল কথা। এ গল্প সে গল্প, ক্যারিকেচার। বাঘের মতো কোনও কড়া ডাক্তার মাঝরাতে সারপ্রাইজ রাউন্ড দিতে আসেন। কুমড়োমোটা মেট্রন হাঁসফাঁস করে কথা বলেন। খ্যাংড়াকাঠি কেরলি ফ্লোর সিস্টার কেমন সেদোটানে ইংরিজি বলে। নকল করতে ছায়া দেবনাথ ওস্তাদ। শুনতে শুনতে অমল একদিন বলে ফেলে,
–তুমি তো দিব্যি অভিনয় করতে পার। এ শহরে তো একসময় অনেক শৌখিন নাটকের দল ছিল। বাংলা নাটক-টাটকও প্রচুর হত। তোমার সঙ্গে চেনাজানা হয়নি?
—কোথায় বাংলা নাটক? কই কোনও দলটলের কথা শুনি না তো। হ্যাঁ, গাঁয়েগঞ্জে বাংলা যাত্রা হয়। শুক্রবারের কাগজে শেষ পৃষ্ঠায় আঞ্চলিক সংস্কৃতির খবর থাকে। আমি ওসব দেখিটেখি না। আপনাদের ভারতীয় বাংলা কি আমার আসে? আমার তো বাঙালি বাংলা। হাসিহাসি মুখে বলে অমল,
–বাঙালি না ঘেচু। বলো বাঙালের বাংলা। ওটা শোধরানো দরকার বুঝেছ। দেশটা একেবারে বাঙালে ছেয়ে গেল।
-আরে রাখেন ওসব কথা। এই তো চেহারা, চোখে দেখেন না? কে আমারে হিরোইন করব? খিলখিল হেসে গড়িয়ে পড়ে ছায়া। যেন ভারি মজার কথা। হ্যাঁ, ছায়া দেবনাথের সব কিছুতেই হাসি। সবসময় মুখে খই ফুটছে। অমল জবাব না দিলে নিজের মনে বকে যায়। এত হাসি, এত কথার ছোঁয়াচ বাঁচানো শক্ত। একদিন ছায়া যেই বলেছে,