- বইয়ের নামঃ ঠিকানা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ঘরে ঢোকে ছায়া দেবনাথ
ঘরে ঢোকে ছায়া দেবনাথ। জানালার সামনে বসা রোগী অমলকুমার দাসকে উদ্দেশ্য করে বলে গুড মর্নিং অমলবাবু। তারপর কেমন আছেন? আসুন প্রেসারটা দেখি। প্রথম প্রথম ছায়া অমলকুমার দাসকে দু-একবার দাদু সম্বোধন করে ফেলেছিল। রোগী অত্যন্ত বিরক্ত। দাদুফাদুবলবেনা। বুড়োবুড়ো লাগে। পরের দিন ছায়া ডাকল, মেসোমশাই। আবার ভুরু কোঁচকায় অমলকুমার দাস। অত মেসোমশাই পিসেমশাইয়ের দরকার কি। আত্মীয়তা পাতাতে আসো কেন,অ্যাঁ? নার্স নার্সের মতো থাকতে পারো না?
অতঃপর অমলবাবু।
রক্তচাপ মেপে জ্বরকাঠিটা মুখে চুষির মতো গুঁজে দিয়ে ছায়া লোহার খাটের পাশে টেবিলে ফাঁইল খুলে লিখতে থাকে।
–বাঃ কাল রাতে তো দিব্যি ঘুমিয়েছেন দেখছি, নাইট্রাসুন, ভ্যালিয়াম কিচ্ছু লাগেনি। কাঠিটা অমলের মুখ থেকে বের করে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে দ্রুতহাতে লেখে ৯৮.৬।
—এক্কেবারে নরম্যাল। খুব ভাল আছেন, নো প্রবলেম। কাল কথাটথা বলেছেন তো?, অমলকুমার দাস কাল কথাটথা বলেনি। অমল কোনদিনই কথাটথা বলে না। নার্স ডাক্তার সবাই চেষ্টা করে তাকে কথাটথা বলাতে। কিন্তু অমল কথা বলে না, কারণ বলার মতো কোনও কথা তার নেই। সে শুধু শোনে। প্রতিদিন এক কথা।
-আপনি খুব ভাল আছেন।
—আপনার গলব্লাডার অপারেশন সাকসেসফুল।
—আপনার প্রস্টেটে আর অসুবিধা নেই।
—আপনার ব্লাডসুগার ইউরিক অ্যাসিড কোলেস্টেরল সব কন্ট্রোলে।
—আলট্রা সাউন্ডে প্যানক্রিয়াসে যে দাগ দেখা দিয়েছিল সেটা আর বাড়েনি।
–আপনি খুব ভাল আছেন। নো প্রবলেম। কিন্তু অমল জানে সে ভাল নেই। সে ভাল ছিল না, ভাল থাকতে পারে না। তাই সে এখানে। কী যেন নাম, সর্বদা গুলিয়ে যায়। লুম্বিনী পাকনা ক্লিনিকনা হোম। না কি লুম্বিনী বন। কোথায় যেন জায়গাটা। মনে করতে চেষ্টা করে। একটা বাজারের কাছে। হ্যাঁ রাস্তাটা হচ্ছে রাজা গোপালাচারী সরণী সংক্ষেপে আর এস, মুখের কথায় আরো অনেক কাল আগে অমলদের আমলে অর্থাৎ যে সময়টাকে অমল নিজেদের সময় মনে করে যখন সে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, কাজকর্ম করেছে-এককথায় যখন সে আর পাঁচজনের মতো কথাটথা বলত—তখন এ জায়গাটার নাম ছিল লেক মার্কেট। সেই বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে চেতলা পর্যন্ত গোটা বড় রাস্তাটা ছিল রাসবিহাবী অ্যাভিনিউ। এখন তিনটে ভাগ। পূর্বদিকে রাস্তা-এ, শেখ আবদুল্লা, মাঝখানে সাবেকী রাসবিহারী, তারপর পশ্চিমে শেষ অংশ আরেস। ধর্মনিরপেক্ষ বহুভাষী ইন্ডিয়ার একটা মহানগরীর এত বড় জনপথ শুধু রাজ্যের সংখ্যাগুরু বঙ্গভাষী হিন্দুর নামে থাকাটা অনুচিত বিবেচিত হওয়ায় একভাগ মুসলমান অন্যভাগ তামিল নাম। ভাষা-ধর্ম সব কিছুতেই তো সংখ্যালঘুদের আলাদা সত্তা। আর তাকে স্বীকার করেই ইন্ডিয়া।
সত্যি কথা বলতে কি স্বীকার করতে অমলেরও কোনদিন আপত্তি ছিল না। আর পাঁচটা উচ্চশিক্ষিত বাঙালির মতো হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে সে উদাসীন। আর বাঙালিয়ানার বাই তার কস্মিনকালেও নেই। শুধু যে সময়ে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে, চাকরি করেছে সেই সময়টাকে সে ছাড়তে পারে না। তার বাস অতীতে। পুরনো বরাবরের চেনাজানা বাস্তবটা পালটে গেছে সেটাই তার ধাতস্থ হয় না। বর্তমানকে কেমন তার ভয়-ভয় করে। যেন পায়ের তলার মাটিটা সরে-সরে যাচ্ছে। অতএব, তার ঠিকানা রুম নম্বর ৩০২ লুম্বিনী পার্ক না ক্লিনিক না হোম না কি বন, ২৪ নং রাজা গোপালাচারী সরণী, আরেস।
কতদিন আছে অমলকুমার দাস এখানে? সামনে সাদা দেওয়ালে চৌকো কার্ড ক্যালেন্ডারে পর পর বদলে যায় দিন মাস সাল। অমল আজ অবাক চোখে দেখে সন ১৯১২, অক্টোবর ১৯। এই যে সিস্টার, হঠাৎ ডেকে ওঠে অমল। ছায়া দেবনাথ থমকে দাঁড়ায়।
—ওটা কী তারিখ লাগিয়ে রেখেছেন?
—কেন? ঠিকই তো আছে। রাতের সিস্টার সকালে রোগীর স্নান ব্রেকফাস্টতদারকি বিছানা ঠিকঠাক সেরে তারিখটা পালটে দেয়। আজও দিয়ে গেছে।
–বলেন কি? এটা দু হাজার বারো? আজ উনিশে অক্টোবর?
—আপনার কী মনে হয়? অন্য কিছু? যেন একটু রহস্যের ছলে প্রশ্ন করে ছায়া। আজকের নিউজপেপার দেখেননি?
প্রতিদিনের মতো আজও সকালে চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ ঘরে এসেছে। প্রতিদিনের মতো নিপাট ভঁজসহ পড়ে আছে ন্যাশনাল ডেইলি। প্রথম চার পৃষ্ঠা হিন্দি, তারপর দুপৃষ্ঠা ইংরেজি ও শেষ এক পৃষ্ঠা বাংলা। ইন্ডিয়ার সব রাজ্য থেকে বেরোয় ন্যাশনাল ডেইলি। প্রথম ছপাতা দিল্লি থেকে আসে সপ্তম পাতা আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী থেকে জুড়ে দেওয়া হয়। ঠিক টিভি প্রোগ্রামের মতো। বেশির ভাগ চ্যানেল হিন্দি,দু-তিনটে ইংরেজি, নামমাত্র কয়েকটি আঞ্চলিক অর্থাৎ আগে যাকে মাতৃভাষা বলা হত সেটি টিমটিম করছে। তবে অমল বহুকাল টিভি দেখে না। কাগজও পড়ে না। দেশে বিদেশে ঘরে বাইরে কত কিছু না কি ঘটে। হবেও বা। অমলের কিছু যায় আসে না।
—আচ্ছা সারাটা দিন আপনি এত চুপচাপ কাটান কী করে? আমি তো বাবা কথা না বলে থাকতেই পারি না। অমলবাবু ও অমলবাবু? কানের কাছে এসে বেশ জোরে জোরে ডাকে মেয়েটা। যেন কানে খাটো কারও সঙ্গে কথা বলছে। আবার কাছে এসে ঝুঁকে মুখের সামনে হাতের আঙুলগুলো মেলে ধরে এপাশ থেকে ওপাশ নাড়ে হাতপাখার মতো।