অদ্ভুত মনে হওয়া! মল্লিকা দেবী, আমিও একজন পুরুষ, এটা বোধ করি আপনি হিসেবের মধ্যে আনেন নি!
এনেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্থির করেছিলাম, আপনি মানুষ!
আপনার এমন বিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এটা কেন ভাবছেন না, হঠাৎ যদি কারও চোখে পড়ে আপনি আমার ঘরে, এবং আলো নিভানো ঘরে, তাহলে অবস্থাটা কি হবে? আমার কথা থাক, আপনার দুর্নাম সুনামের কথাই ভাবুন!
ভাবছি। বুঝতে পারছি। মল্লিকা আরও ক্লান্ত গলায় বলে, কিন্তু তবু সে তো মিথ্যা দুর্নাম। সত্যিকার বিপদ নয়, বাঘের কামড় নয়!
অন্ধকারেই জিনিসপত্র বাঁচিয়ে বারকয়েক পায়চারি করে প্রভাত তারপর দৃঢ়স্বরে বলে, কিন্তু সেই বদলোকটা যে কে, আপনার চেনা দরকার ছিল। আপনার মামাকে তার স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
মামাকে! আমার মামাকে! মল্লিকা আর একবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমার মামাকে আপনি চেনেন না তাই বলছেন! মামা তার খদ্দেরকে খুসি করতে, নিজেই আমাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিতে চান–
মল্লিকা দেবী!
তীব্র একটা আর্তনাদ ঘরের স্তব্ধতাকে খানখান করে ফেলে।
.
না!
সে আর্তনাদের শব্দ কারও কানে প্রবেশ করে ভয়ঙ্কর একটা কেলেঙ্কারির সৃষ্টি করে নি। মোটা কাপড়ের পর্দা ঘেরা কাঁচের জানালা ভেদ করে কারও নিশ্চিন্ত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় নি।
এখন সকাল। এখন প্রভাত এসে দাঁড়িয়েছে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্যের সামনে। গত দুদিন শুধু সামনেই তাকিয়ে দেখেছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। আজ দুপাশে যতদূর দৃষ্টি চলে দেখতে থাকে। ডানদিকে নীচু জমিতে ওই চালাঘরটা তাহলে মুরগীর ঘর। ওর জালতির দরজাটা সন্দেহের নিরসন করছে।
রাত দুটোর সময় ওইখানে নেমেছিল মল্লিকা ডিমের সন্ধানে?
মল্লিকা কি পাগল?
কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ও কি একটা গল্প বানিয়ে বলে গেল?
কিন্তু তা কি কখনও সম্ভব?
চিরদিন সাধারণ ঘর-গেরস্থীর মধ্যে মানুষ নিঃসন্দিগ্ধচিত্ত প্রভাতের ওই সন্দেহটাকে সম্ভব বলে মনে করতে বাধে।
তবে চ্যাটার্জির যে রূপ উদঘাটিত করলো মল্লিকা, সেটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেবে, এত অবোধ সরলও নয় প্রভাত। জগতের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ না দেখুক, জানে বৈকি।
স্বার্থের প্রয়োজনে স্ত্রী কন্যা বোনকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়, জগতে এমন পুরুষের অভাব নেই একথা প্রভাত জানে না এমন নয়। এই দণ্ডে এই পিশাচ লোকটার আশ্রয় ত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার।
কিন্তু
কিন্তু কী এক অমোঘ অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেল সে। তাই ভাবছে, মল্লিকাকে সে কথা দিয়েছে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এই নরক থেকে, এই হিংস্র জানোয়ারের গুহা থেকে।
অথচ জানে না কেমন করে রাখবে সেই প্রতিজ্ঞা!
কাল নিরীক্ষণ করে দেখার দরকার হয়নি, আজ দেখছে। দেখছে সমস্ত সীমানাটা কাটা তারের বেড়ায় ঘেরা, সেই ব্যাঘ্ৰসদৃশ কুকুরগুলো চোখে দেখেনি বটে, কিন্তু রাত্রে তাদের গর্জন মাঝে মাঝেই কানে এসেছে।
রাতে যাওয়া হয় না। তাছাড়া যানবাহন কোথা? সেই চ্যাটার্জির জিপগাড়ীই তো মাত্র ভরসা। এক যদি মল্লিকা শহরের দিকে যাবার কোনও ছুতো আবিষ্কার করতে পারে।
কিন্তু মল্লিকা বলেছে, অসম্ভব।
কিন্তু তুমি তো মামার সঙ্গে রোজ স্টেশনে যাও লোক ধরতে! বলেছিল প্রভাত।
হ্যাঁ, মামার সঙ্গে! মল্লিকা মৃদু তীক্ষ্ণ একটু হেসেছিল।
তবু তাকে আশ্বাস দিয়েছে প্রভাত।
প্রভাত নয়, প্রভাতের শিরায় শিরায় প্রবাহিত পুরুষের রক্ত। যে রক্ত পুরুষানুক্রমে মধ্যবিত্ত জীবনের দায়ে স্তিমিত হয়ে গেলেও একেবারে মরে যায়নি। আশ্বাস দিয়েছে সেই রক্ত। আশ্বাস দিয়েছে তার যৌবন।
চায়ের সময় হয়ে গেছে।
প্রভাত এখনো নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় নি। আকাশে আলো ফুটতে ফুটতেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
এখন ফের ঘরে এল। সাবান তোয়ালে টুথব্রাশ নিয়ে সংলগ্ন স্নানের ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখল বিছানাটার দিকে।
রাত দুটোর পর আর শোয়া হয়নি প্রভাতের। শোবার সময় হয়নি, হয়তো বা সাহসও হয়নি। এখন তাকিয়ে দেখছে কোথায় বসেছিল সেই ক্রন্দনবতী। কোনখানটায় আছড়ে পড়ে চোখের জলে সিক্ত করে তুলেছিল।
সত্যিই কি এসেছিল কেউ? নাকি প্রভাতের স্বপ্নকল্পনা? চমকে বিছানার কাছে এগিয়ে এল। বালিশের গায়ে একগাছি লম্বা চুল।
ঈশ্বর রক্ষা করেছেন!
এখুনি চাকরবাকর বিছানা ঝাড়তে আসবে। এ দৃশ্য যদি তাদের চোখে পড়ত! চারিদিকে সন্ধানীদৃষ্টি ফেলে ফেলে দেখল আর কৈাথাও আছে কিনা।
নেই। নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
কিন্তু?
সমস্ত নিশ্চিন্ততা ছাপিয়ে মল্লিকার একটা কথা মাথার মধ্যে কাটার মত বিধছে। সে কাটা বলছে–একথা কেন বলল মল্লিকা?
কথাটা আবার মনের মধ্যে স্পষ্ট পরিষ্কার উচ্চারণ করল প্রভাত। নতুন করে আশ্চর্য হল।
প্রতিজ্ঞা! প্রতিজ্ঞা করছেন? পুরুষের প্রতিজ্ঞা! কিন্তু আপনি কী সত্যি পুরুষ? তীব্র তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত একটু হেসেছিল মল্লিকা এই প্রশ্নের সঙ্গে।
কোন কথার পিঠে এ প্রশ্ন উঠেছিল তা মনে পড়ছে না প্রভাতের। বোধ করি প্রভাতের প্রতিজ্ঞামন্ত্র পাঠের পর। নাকি তাও নয়?
না, তা নয়। বোধহয় চলে যাবার আগে। হ্যাঁ তাই। চলে যাবার আগে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিল, প্রতিজ্ঞা করছেন? পুরুষের প্রতিজ্ঞা? কিন্তু আপনি কি সত্যি পুরুষ!