সিদ্ধান্ত করলে, খাবে, ঘুমোবে, কাজে যাবে, ব্যস।
মনটা ভালো করে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল প্রভাত।
ঘড়িতে দেখল রাত পৌনে দশটা।
কিন্তু প্রভাতের নিশ্চিন্ততার সুখ যে ঘণ্টাকয়েক পরেই এমনভাবে ভেঙে যাবে, তা কি সে স্বপ্নেও ভেবেছিল? ঘণ্টা কয়েক!
কঘণ্টা? পৌনে দশটার পর শুয়ে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে প্রভাত? ঘুমের মধ্যে সময় নির্ণয় হয়, তবু প্রভাতের মনে হল ঘণ্টা তিন-চার পার হয়েছে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, জানলার কাছে খুব দ্রুত আর জোরে একটা টকটক শব্দে। পিছনের খোলা বারান্দার দিকের জানলা।
ভয়ে বুকটা ঠাণ্ডা মেরে গেল প্রভাতের, ঝপ করে বেডসুইচটা টিপে আলোটা জ্বেলে ফেলে কম্পিত বক্ষে সেই দিকে তাকাল।
কে ও?
চোর ডাকাত? খুনে গুণ্ডা?
জানলা ভেঙে ফেলবে? অশরীরী যে একটা আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছিল সেটা তাহলে ভুল নয়!
নাকি সেই বাঘের চাইতে ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোরই কোনও একটা কচ আঁচড়াচ্ছে!
কিন্তু তাই কি? এ তো নির্ভুল মানুষের আওয়াজ! যেন সাঙ্কেতিক!
কাঁচ ভেদ করে গলার শব্দ আসে না, তাই বোধহয় ওই শব্দটাই অবলম্বন করেছে।
শব্দ মুহুর্মুহু বাড়ছে। টকটক! টকাট খটখট!
কেউ কোন বিপদে পড়েনি তো! দেখবে নাকি! না দেখলেও তো বিপদ আসতে পারে। ঈষৎ ইতস্তত করে প্রভাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা সরাতে গিয়েই চমকে উঠল।
কী সর্বনাশ এ যে মল্লিকা!
কোনো বিপদে পড়েছে তাহলে!
মল্লিকা এতক্ষণ ব্যাকুল আবেদন জানাচ্ছে, আর প্রভাত বোকার মত বিছানায় শুয়ে ভয়ে কাঁপছে? কী বিপদ! কুকুরে তাড়া করে নি তো?
কী ভাবে যে জানলার ছিটকিনিটা খুলে ফেলেছিল প্রভাত তা আর মনে নেই, শুধু দেখতে পায় জানলা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই মল্লিকা উদ্ভ্রান্তের মত ঝুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে জানলাটা ফের বন্ধ করে দিয়ে আর পর্দাটা টেনে দিয়ে প্রভাতের বিছানার ধারে বসে হাঁফাচ্ছে।
প্রভাত চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ! এ কী! এর মানে কী!
হাঁফানো থামলে মল্লিকা কাতর বচনে বলে, মিস্টার গোস্বামী, আমায় ক্ষমা করুন, দয়া করে আলোটা নিভিয়ে দিন।
প্রভাত প্রায় অচেতনের মত এই অভূতপূর্ব ঘটনার সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাত দুটোর সময় তার বিছানার উপর একটি বেপথু সুন্দরী তরুণী।
এ স্বপ্ন? না মায়া?
কথা কইলে বুঝি এ স্বপ্ন ভেঙে যাবে, এ মায়া মুছে যাবে!
ভেঙে গেল স্বপ্ন, মুছে গেল মায়া। প্রবল একটা ঝাঁকুনি খাওয়ার মত চমকে উঠল প্রভাত, কী বলছে বেপরোয়া মেয়েটা!…
দয়া করে আলোটা নিভোন!
প্রভাত প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী বলছেন আপনি?
মিস্টার গোস্বামী, কী বলছি, তার বিচার পরে করবেন, যদি আমাকে বাঁচাতে চান–
হঠাৎ নিজেই হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয় মল্লিকা। বিছানার উপর ভেঙে পড়ে চাপা কান্নায় উদ্বেল হয়ে ওঠে।
আর সেই অন্ধকার ঘরের মাঝখানে প্রভাত বাকশক্তিহীন ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে।
কতক্ষণ?
কে জানে কতক্ষণ! হয়তো বা কত যুগ!
যুগ-যুগান্তর পরে কান্নার শব্দ স্তিমিত হয়, অন্ধকারেও অনুভব করতে পারে প্রভাত, মল্লিকা উঠে বসেছে।
কান্নাভেজা গলায় আস্তে কথা বলে মল্লিকা, মিস্টার গোস্বামী, আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাবছেন!
ভূতের মুখে বাক্য ফোটে, আপনাকে কি নিজেকে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না!
আপনি ধারণা করতে পারবেন না মিস্টার গোস্বামী, কী অবস্থায় আমি এভাবে আপনাকে উত্ত্যক্ত করতে এসেছি!
অবস্থাটা যদি এত ভয়াবহ না হত, শুধু স্নায়ু নয়, অস্থিমজ্জা পর্যন্ত এমন করে সিঁটিয়ে না উঠত, তাহলে হয়তো প্রভাত সহানুভূতিতে গলে পড়ত, কী ব্যাপার ঘটেছে জানবার জন্যে ব্যাকুলতা প্রকাশ করত। কিন্তু অবস্থাটা ভয়াবহ। তাই প্রভাতের কণ্ঠ থেকে যে স্বর বার হয়, সেটা শুকনো, আবেগশূন্য।
সত্যিই ধারণা করতে পারছি না। কিন্তু দয়া করে আলোটা জ্বালতে দিন, অবস্থাটা অসহ্য লাগছে।
না না না! মল্লিকা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, চলে যাব, ভোর হলেই চলে যাব আমি। শুধু ঘণ্টা কয়েকের জন্যে আশ্রয় দিয়ে বাঁচান আমাকে।
কিন্তু মল্লিকা দেবী, আপনার এই বাঁচা-মরার ব্যাপারটা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি!
পারবেন না। সে বোঝবার ক্ষমতা আপনাদের পুরুষদের থাকে না। তবু কল্পনা করুন, বাঘে তাড়া করেছে আমাকে।
বাঘে!
অস্ফুট একটা আওয়াজ বার হয় প্রভাতের মুখ থেকে। ভাষার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করবার আগেই পিছনের সেই পাহাড়ের কোল পর্যন্ত প্রসারিত অন্ধকার তৃণভূমির দৃশ্যটা মানশ্চক্ষে ভেসে ওঠে তার, আর অস্ফুট ওই প্রশ্নটা উচ্চারিত হয়।
অন্ধকারে অসহনীয় ধাক্কাটা বুঝি ক্রমশ সহনীয় হয়ে আসছে, ভেন্টিলেটার দিয়ে আসা দূরবর্তী কোনও আলোর আভাস ঘরের চেহারাটা পরিস্ফুট করে তুলছে। হাসির শব্দটা, লক্ষ্য করে অনুমান করতে পারছে প্রভাত, মল্লিকার মুখে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের রেখা। সেই রেখার কিনারা থেকে উচ্চারিত হল, হ্যাঁ বাঘই! শুধু চেহারাটা মানুষের মত!
স্তব্ধতা। দীর্ঘস্থায়ী একটা স্তব্ধতা।
তারপর একটা নিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, এরকম পরিবেশে এইরকম ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বলতে পারেন, এত রাত্রে আপনি নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন কেন?
আবার মিনিটখানেক নিস্তব্ধতা, তারপর মল্লিকার ক্লান্ত করুণ স্বর ধ্বনিত হয়, এই আমার ললাটলিপি মিস্টার গোস্বামী! চাকরবাকর শুয়ে পড়ে, আমাকে তদারক করে বেড়াতে হয়, আগামী ভোরের রসদ মজুত আছে কিনা দেখতে! হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে মনে পড়ল, স্টোরে সকলের ব্রেকফাস্টের উপযুক্ত ডিম নেই। তাই মুরগীর ঘর তল্লাস করতে গিয়েছিলাম। মিস্টার গোস্বামী, কেন জানি না আমার হঠাৎ মনে হল আপনার ঘরটাই নিরাপদ আশ্রয়!