গণেশকে প্রশ্ন করল, গাড়ীতে আর যে দুজন ভদ্রলোক ছিল ওরা এখানে বরাবর থাকে?
গণেশ গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে, কি জানি!
কি জানি মানে? তুমি জানো না?
আজ্ঞে না বাবু, আমাদের কিছু জানবার আইন নেই।
ব্যাপার কি বল তো? এখানে কিছু রহস্য-টহস্য আছে নাকি? প্রভাত উত্তেজিত ভাবে বলে, তোমাদের মালিক যখন স্টেশন থেকে নিয়ে এলেন, তখন যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম তো দেখছি না।
গণেশ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, বেশি ভাবাভাবির দরকার কি বাবু? আছেন থাকুন। কোনও অসুবিধে হয় জানাবেন, চুকে গেল।
গাড়ীতে যারা গেল, তাদের আমার ভালো লাগে নি।
তা বিশ্বসুন্ধু লোককে ভালো লাগবে তার কি মনে আছে? গণেশ ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে বলে, রেলগাড়ীতে কত লোক পাশে বসে যায়, সবাইকে আপনার ভালো লাগে? আপনি বাঙালী, আপনার ভালোর জন্যেই বলছি বাবু, নিজের তালে থাকুন সুখে থাকবেন। অন্যদিকে নজর দিতে গেলে বিপদ আছে।
গণেশ চলে যায়।
প্রভাতের মনে হয়, লোকটা নেহাৎ সামান্য চাকর নয়। কথাবার্তা বড্ড বেশি ওস্তাদমার্কা।
আজও দেরি করে করে খেলো প্রভাত, আর হঠাৎ মনে করল এখানে থাকব না। চ্যাটার্জির আরামকুঞ্জ ছাড়া সত্যিই কি আর জায়গা জুটবে না? অফিস অঞ্চলে চেষ্টা দেখব।
.
পিছনের বারান্দার দিকটা অন্ধকার, তার নীচেই সেই সুবিস্তীর্ণ জমি, জানালাগুলোয় শিক নেই, শুধু কাঁচের শার্সি সম্বল।
নাঃ, চলেই যাবে। অস্বস্তি নিয়ে থাকা যায় না।
খাওয়ার পর চিঠি লিখতে বসল,–শ্রীচরণেষু কাকিমা, আশা করি কাকাকে লেখা আমার পৌঁছানো সংবাদ পেয়েছেন। লিখেছিলাম বটে থাকার জায়গা খুব ভালো পেয়েছি, কিন্তু একটা মস্ত অসুবিধে, অফিস অনেক দূর। রোজ যাতায়াতের পক্ষে বিরাট ঝামেলা। তাই ভাবছি, অফিস অঞ্চলে একটা ব্যবস্থা করে নেব। নতুন ঠিকানা হলেই জানাব। ইতি।
আজও ভাবল কাকিমাকে মল্লিকার কথাটা লিখলে হত।
কিন্তু লিখতে গিয়ে ভাবল কথাটাই বা কী, এখানে একটি মেয়ে আছে, নাম মল্লিকা,–তার পর?
এটা কি একটা কথা?
অথচ কথাটা মন থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না।
.
চিঠিখানা কাল পাছে পোস্ট করতে ভুলে যায়, তাই অফিসের কোর্টের পকেটে রেখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল প্রভাত।
দরজায় দাঁড়িয়ে চ্যাটার্জি।
পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়ে। প্রভাতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে নীচু হয়ে বলল, এই দেখতে এলাম আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা।
প্রভাত ভুরুটা একটু কুঁচকে বলল, কই, আমাকে তো ডাকেন নি মিস্টার চ্যাটার্জি।
আহা-হা ডাকব কেন, ডাকব কেন? তন্ময় হয়ে চিঠি লিখছিলেন–স্ত্রীকে বোধহয়! চ্যাটার্জির গোঁফের ফাঁকে একটু হাসি ঝলসে ওঠে।
প্রভাতের গতকাল এই বিনয়-নম্র লোকটাকেই ঈশ্বরপ্রেরিত মনে হয়েছিল, কিন্তু আজ ওর এই অতি বিনীত ভাবটাতে গা জ্বলে গেল। তাছাড়া মনে পড়ল, মল্লিকার মামা–তাই ঈষৎ কঠিন স্বরে বলে উঠল, স্ত্রী ছাড়া জগতে আর কাউকে কেউ চিঠি লেখে না? আহা লিখবে না কেন? আর একটু ধূর্তহাসি হাসেন চ্যাটার্জি, লেখে পোস্টকার্ডে, দুপাঁচ লাইন। আর এত তন্ময় হয়েও লেখে না। আমরা তো মশাই এটাই সার বুঝি।
আপনারা যা বোঝেন, হয়তো সেটাই সব নয়। চিঠি আমার কাকিমাকে লিখেছি। বলে কথায় উপসংহারের সুর টেনে দেয় প্রভাত।
কিন্তু চ্যাটার্জি উপসংহারের এই ইঙ্গিত গায়ে মাখেন না। একটা অভব্য কৌতুকের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলে ওঠেন, কা-কি-মা-কে! আপনি যে তাজ্জব করলেন মশাই! কাকিমাকে চিঠি, তাও এত ইয়ে! তা কী লিখলেন?
প্রভাত আর শুধু ভুরু কুঁচকেই ক্ষান্ত হয় না, প্রায় ক্রুদ্ধ গলায় বলে, প্রশ্নটা কি খুব ভদ্রতাসঙ্গত হল মিস্টার চ্যাটার্জি?
আহা-হা, চটছেন কেন? চটছেন কেন? এমনি একটা কথার কথা বললাম। বারোমাস যত নবেঙ্গলী নিয়ে কারবার, দুটো খোলামেলা কথা তো কইতে পারি না। আপনি বাঙালী বলেই–যাক, যদি রাগ করেন তো মাপ চাইছি।
এবার প্রভাতের লজ্জার পালা।
ছি ছি, বড় অসভ্যতা হয়ে গেল! হয়তো লোকটা ভাগ্নীর কাছে গিয়ে গল্প করবে। কী মনে করবে মল্লিকা তা কে জানে!
আসলে লোকটা মুখ। তাই ভাবভঙ্গিতে কেমন অমার্জিত ভাব। নেহাৎ পদবীটা চ্যাটার্জি তাই, নইলে নেহাৎ নীচু ঘরের মনে হত!
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, না না, রাগের কথা নয়। লক্ষ্ণৌতে কাকা-কাকিমার কাছেই ছিলাম এতদিন, এসে চিঠিপত্র না দিলে ভালো দেখায়? তা লিখছিলাম কাকিমাকে চিঠি, বললেন স্ত্রীকে-মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মাথা নেই তার মাথাব্যথা!
তাই নাকি? হা-হা-হা! ভারি মজার কথা বলেন তো আপনি! চ্যাটার্জি হেসে ঘর ফাটান।
.
চ্যাটার্জি চলে গেল, প্রভাত ভাবতে থাকে, অকারণ বিরূপ হচ্ছি কেন? না না, এটা ঠিক নয়। সন্দেহের কিছু নেই। রহস্যই বা কি থাকবে! লোকটা ঝুনো ব্যবসাদার, এই পর্যন্ত। জিপের সহযাত্রীরা বাঙালী নয়, এতে বিরক্তির কি আছে? অফিসে তো সে ছাড়া আর একজনও বাঙালী নেই! যাচ্ছে না প্রভাত সেখানে?
গণেশটার কথাবার্তাই একটু বেশি কায়দার। যেন ইচ্ছে করে রহস্য সৃষ্টি করতে চায়। ওর সঙ্গে আর কথা বেশি বলার দরকার নেই।
আর–
আর মল্লিকার সঙ্গেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কী দরকার প্রভাতের, কার মামা তার ভাগ্নীর প্রতি অন্যায় ব্যবহার করছে কি ন্যায় ব্যবহার করছে, তার হিসেব নিতে যাওয়া!