লোকজনকে দিয়ে কি সব হয়? অতিথির আদর অভ্যর্থনা নিজেরা না করলে চলে?
শুনে সহসা প্রভাতের সংস্কারগ্রস্ত গৃহস্থমন বিরূপ হয়ে ওঠে আর অধিকার অনধিকারের প্রশ্ন ভুলে বলে ফেলে সে, এটা আপনার আপত্তি করা উচিত।
মল্লিকা নিরীহভাবে বলে, কোনটা অন্যায়? কিসে আপত্তি করা উচিত?
এই, যে আসে তার আদর অভ্যর্থনার দায়িত্ব আপনার নেওয়া! কতরকমের লোক আসে, আর এইসব অঞ্চলের নানা জাতের ব্যবসায়ীরা যে কী ধরনের লোক হয়, জানেন না তো?
মল্লিকা আরও নিরীহভাবে বলে, আপনি জানেন?
এর আর জানাজানির কি আছে! প্রভাত সবজান্তার ভঙ্গীতে বলে, কে না জানে! না না, আপনি ওসব দিকে যাবেন না।
বাঃ, মামার ব্যবসার দিকটা তো দেখতে হবে?
দেখতে হবে! প্রভাত চটে উঠে বলে, মামার ব্যবসাটাই বড় হল? নিজের মান-সম্মানটা কিছু নয়?
কে বললে মানসম্মানের হানি হয়? আবার উত্তেজিত হয় মল্লিকা।
হয় না? আপনি বলছেন কি? প্রভাত উত্তেজিত ভাবে বলে, এমন কিছু কম বয়স আপনার নয় যে জগতের কিছু বোঝেন না! এ থেকে আপনার ক্ষতি হতে পারে, এ আশঙ্কা নেই আপনার?
মল্লিকা গম্ভীর হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে বলে, আশঙ্কা থাকলেই বা কি! আমার জীবন তো এইভাবেই কাটবে!
প্রভাত এই বিষণ্ণ কথার ছোঁয়ায় একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বলে, বাঃ তাই বা কাটবে কেন? মেয়েদের জীবনে তো মস্ত একটা সুবিধে আছে, বিয়ে হলেই তারা একটা নতুন পরিবেশে চলে যেতে পায়!
হুঁ, সুবিধেটা মস্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিয়ে না হলে?
বিয়ে না হলে! প্রভাত দুর্বলভাবে বলে, না হবে কেন?
সেটাই স্বাভাবিক। মল্লিকা হেসে ওঠে, মা-বাপ-মরা মেয়ে, মামার কি দায়!
প্রভাত বোধ করি আবার ভুলে যায় সে কে, কী তার অধিকার, তাই রীতিমত চটে উঠে বলে, দায় অবশ্যই আছে। এদিকে তো বাঙালীয়ানার খুব বড়াই করলেন আপনার মামা, বাঙালী সংসারে বাপ-মরা ভাগ্নীর বিয়ে দেবার দায় থাকে না? তা থাকবে কেন, আপনাকে দিয়ে দিব্যি সুবিধে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে—
মল্লিকা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে, খুব তত বড় বড় কথা বলছেন, আপনি আমার বিষয়ে কতটুকু জানেন? জানেন, মামা আমাকে দিয়ে কি কি সুযোগ সুবিধে পাচ্ছেন?
বেশি জানবার কিছু নেই। নিজের চক্ষেই তো দেখলাম, খাতা লিখছেন হিসেবপত্তর দেখছেন, বোর্ডারদের সুবিধে-স্বাচ্ছন্দ্য দেখছেন, নিজে মুখেই তো বললেন, অহোরাত্র খাটছেন। এই যথেষ্ট, আর বেশি না জানলেও চলবে। আমি বলব আপনার মামার এটা রীতিমত স্বার্থপরতা। আর আপনার উচিত এর প্রতিবাদ করা।
সত্যি! হঠাৎ বেদম খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মল্লিকা। আর নেহাত বাঁচাল মেয়ের মত বলে ওঠে, মনে হচ্ছে, আমার ওপর আপনার বড় মায়া পড়ে গেছে! লক্ষণ ভালো নয়।
উপহাস করছেন?
আহত কণ্ঠে বলে প্রভাত।
কে বললে? মল্লিকা হাসি থামিয়ে বলে, খাঁটি সত্য কথা। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছেন কি, মামা এরকম স্বার্থপর না হলে আপনিই বা আমার জন্যে এত দুশ্চিন্তা করবার অবকাশ পেতেন কোথায়? আপনার সঙ্গেও তো সেই একই সম্পর্ক, মামার বোর্ডার!
প্রভাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, আরক্ত মুখে বলে, মাপ করবেন। নিজের পোজিশানটা হঠাৎ ভুলে গিয়েছিলাম।
.
আরাম কুঞ্জের ডানপাশের রাস্তায় জিপগাড়ীটা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রভাত অফিসের সাজে সজ্জিত হয়ে এসে দেখল ভিতরে আরও দুজন ইতিমধ্যেই আসীন।
গতকাল একাই গিয়েছিল, এবং আজও সেইরকম ধারণা নিয়েই আসছিল, সহযাত্রীযুগলকে দেখে মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল।
তা প্রভাত কি কুনো? মানুষ ভালবাসে না সে?
ঠিক তাও নয়। সত্যিকথা বললে বলতে হয়, প্রভাত একটু প্রাদেশিকতা-দোষদুষ্ট। সহযাত্রীরা বাঙালী হলে সে যে পরিমাণ প্রসন্ন হয়ে উঠত, সেই পরিমাণ অপ্রসন্ন হল ওদের দেখে।
বিদেশী পদ্ধতিতে একটু সৌজন্যসূচক সম্ভাষণ করে প্রভাত গম্ভীর মুখে উঠে বসল। দেখল পায়ের কাছে তিনটা টিফিনকেরিয়ার বসানো এবং তাদের হাতলে এক-একটা সূতো বেঁধে অধিকারীর নামের টিকিট লটকানো।
মিঃ গোস্বামী, মিঃ ট্যাণ্ডন, মিঃ নায়ার। প্রভাত ভাবল সর্বধর্ম সমন্বয়। ভাবল চ্যাটার্জি লোকটা ঝুনো ব্যবসাদার বটে!
গাড়ী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল, তিনটি যাত্রী কেউ কারও সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করলে না। শুধু প্রভাতের মনে হল, অন্য দুজন যেন অনবরত তার দিকেই লক্ষ্য করছে।
মনের ভ্রম? না কি সম্পূর্ণ সাধারণ ব্যাপার?
প্রভাতও তো বারবারই ওদেরই দেখেছে।
.
আজও সন্ধ্যায় গণেশ ও সেই অপর একজন খাবার নিয়ে এল। এবং যথারীতি মল্লিকার দেখা মিলল না।
সকাল থেকে অকারণেই প্রভাতের মনটা বিষ হয়ে ছিল। সকালের সেই লোকদুটো এ বেলাও সহযাত্রী হয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে এই ব্যবস্থাই চলতে থাকবে। জিপের ব্যবস্থা দেখে কাল খুসি হয়েছিল, আজ বিরক্তি বোধ করছে।
কম্পাউণ্ডের মধ্যে এদিক ওদিক দুচারখানা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে, জগতের সকলেরই প্রভূত টাকা আছে। নেই শুধু প্রভাতের।
নিজের একখানি কার চালিয়ে যথেচ্ছ বেড়াতে পাওয়াটাই প্রভাতের মতে আপাতত জগতের শ্রেষ্ঠ সুখের অন্যতম মনে হতে লাগল। জিপের জন্যে আলাদা চার্জ দিতে হবে, অথচ কেমন যেন দয়া-দয়া ভাব। নিজেকেও দয়ার ভিখিরীর মত লাগছে।