কত রকমের শব্দ! কত জুতোর শব্দ, কত কথার শব্দ, কত গ্লাস প্লেট পেয়ালার ঠুং ঠাং শব্দ….কত লোক আসে এখানে? আর আসে কি রাত্রেই বেশি?
কেন?
অচেনা পরিবেশে রাত্রির এই মুখরতায় একটু যেন ভয়-ভয় করল প্রভাতের, গা-টা সির সির করে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে দেখল, ছিটকিনি লাগিয়েছে কিনা।
তারপর ঘড়ি দেখল। মাত্র এগারোটা। তখন লজ্জা করল প্রভাতের।
নিজে সন্ধ্যা আটটায় শুয়ে পড়েছে বলেই মনে করছে কি না জানি গভীর রাত! এই সময় লোকজন বেশি হওয়াই তো স্বাভাবিক!
পাখী সারাদিন আকাশে ওড়ে কিন্তু সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে!
এইসব বিজনেসম্যানেরা সারাদিন অর্থের ধান্ধায় কোথায় খায়, কোথায় থাকে, কিন্তু রাত্রে আস্তানায় ফেরে, খায়-দায় আড্ডা জমায়। মদই কি আর না খায়? ভাবল প্রভাত।
আমাদের বিবেচনাশীল প্রোপাইটার মশাই অবশ্যই সে ব্যবস্থা রেখেছেন। আবার ভয় এল।
কেউ মাতাল-টাতাল হয়ে গোলমাল করবে না তো! মাতালে বড় ভয় প্রভাতের।
কিন্তু না। শব্দ ক্রমশ কমে এল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রভাত।
পরদিন চায়ের টেবিলে মল্লিকার আবির্ভাব। গত কালকের মত প্রসাধনমণ্ডিত নয়, একটু যেন ঢিলেঢালা। সদ্য স্নান করেছে, খোলা ভিজে চুল।
প্রভাতের মনে হল, এ আরও অনেক মনোরম।
কাল ভেবেছিল রূপসী। আজ ভাবল সুন্দরী! কাল মনে করেছিল মনোহর। আজ মনে করল মনোরম। .
বয়সের ধর্ম, প্রভাত একটু অভিমান দেখাল, কাল তো আর আপনার দর্শনই মিলল না!
মল্লিকা দুটো চেয়ারের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। মধুর হাসি হেসে বলল, দেবীদর্শন এত সুলভ নাকি?
হ্যাঁ, তাই ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। আর আজও প্রত্যাশার পাত্র উপুড় করে রেখেছিলাম।
উঃ কী কাব্যিক কথা! চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
চোখ ঠাণ্ডা হলে, চা চুলোয় গেলেও ক্ষতি হয় না।
মল্লিকার মুখটা সহসা একটু কঠিন হয়ে ওঠে। চাচাছোলা টানটান মুখটায় এই সামান্য পরিবর্তনটাই চোখে পড়ে।
সেই কঠিনমুখে বলে মল্লিকা, কমবয়েসী মেয়ে দেখলেই কি এরকম কাব্যি জেগে ওঠে আপনার?
মুহূর্তে অবশ্য প্রভাতের মুখও গম্ভীর হয়ে যায়। চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিয়ে সে বলে, ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন।
রাগ হয়ে গেল?
রাগ নয়, চৈতন্য।
অত চৈতন্যদেব না হলেও ক্ষতি নেই। আমি শুধু একটু কৌতূহল প্রকাশ করেছি। কারণ কি জানেন, আমি আপনাকে সাধারণ পুরুষদের থেকে আলাদা ভেবেছিলাম।
প্রভাত এবার চোখ তুলে তাকায়।
একটি বদ্ধ গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, হয়তো আপনার ধারণা ভুল ছিল না। এটা ব্যতিক্রম। কিংবা হয়তো আমি নিজেই নিজেকে জানতাম না। কোনও অনাত্মীয় মেয়ের সঙ্গে আলাপের সুযোগও তো আসেনি কখনো।
ওঃ, বুঝেছি। মল্লিকা হেসে ওঠে, একেবারে গৃহপোষ্য। তাই সোনা কি রা চিনতে শেখেনু নি এখনো!
তার মানে?
মানে নেই। খান, খেয়ে ফেলুন।
কিন্তু দেখুন সকালে এত খাওয়া! এখুনি তো আবার অফিস যেতে হবে ভাত খেয়ে–
না তো! মল্লিকা বিস্মিত দৃষ্টিতে বলে, তাই অভ্যাস নাকি আপনার? কাল যে বললেন–ইয়ে আমরা তো আপনার লাঞ্চটা টিফিনক্যারিয়ারে ভরে জিপে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
বলেন কি! এ যে ধারণার অতীত।
কেন?
বাঃ। বাড়ীতেও তো এমন ব্যবস্থা সবসময় হয়ে ওঠে না।
মল্লিকা হঠাৎ একটা দুষ্টহাসি হেসে বলে, বাড়ীতে বউ নেই বোধহয়? বুড়ো মা-পিসিকে দিয়ে আর কত
প্রভাতের মুখে একটা পরিহাসের কথা আসছিল, মুখে আসছিল–বৌ তো কোনখানেই নেই! কিন্তু মল্লিকার ক্ষণপূর্বের কাঠিন্য মনে করে বলল না।
শুধু বলল, নাঃ, আপনাদের ব্যবস্থা সত্যিই ভালো।
শুনে সুখী হলাম। কিন্তু উত্তরটা পাইনি।
উত্তর? কিসের উত্তর?
ঘরে বৌ আছে কিনা?
জেনে আপনার লাভ? লাভ?
আপনি বুঝি প্রতিটি কথাও খরচ করেন লাভ-লোকসানের হিসেব কষে?
তা পৃথিবীর নিয়ম তো তাই।
হুঁ। পৃথিবীর নিয়মটা খুব শিখে ফেলেছেন দেখছি। কাল তো সন্ধ্যাবেলাই শয্যাশ্রয় করলেন। নতুন জায়গায় ঘুম হয়েছিল?
প্রভাত হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল সেই উদার উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে। আজ আর মেঘলা নেই। সকালের নির্মল আলোয় ঝকঝক করছে। মল্লিকার প্রশ্নে সচকিত হয়ে বলে, ঘুম? সত্যি বলতে প্রথম দিকটায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এত রকম শব্দ!
শব্দ! কিসের শব্দ? একটু যেন উত্তেজিত দেখায় মল্লিকাকে।
প্রভাত বিস্ময় বোধ করে হেসে ওঠে, ভয় পাবার কিছু নেই, বাঘের গর্জনের শব্দ নয়। মানুষের পায়ের, বাসনপত্রের, টুকরো কথার
আর কিছু নয়? মল্লিকার দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে।
প্রভাত ভাবে, মেয়েটার তো মুহূর্তে মুহূর্তে খুব ভাব পরিবর্তন হয়। কিন্তু কেন হয়? মুখে বলে, না তো! আর কি হবে?
মল্লিকা নরম হয়ে যায়। সহজ হয়ে যায়। বলে, তাই তো! আর কি হবে! তবে বাঘের গর্জনও অসম্ভব নয়।
অসম্ভব নয়! বাঘ আছে! প্রভাত প্রায় ধসে পড়ে।
আর মল্লিকা হেসে ওঠে, ভয় পাবেন না, পাহাড়ের ওদিকে বাঘ ডাকে। তবে বাঘের চাইতে ভয়ঙ্কর তিন-তিনটে কুকুর রাত্রে পাহারা দেয় এখানে। চেন খুলে রাখা হয়। বাঘও ভয় পায় তাদের।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর আস্তে বলে প্রভাত, সন্ধ্যেবেলা আপনি খুব খাটেন, তাই না?
শুধু সন্ধ্যেবেলা? সর্বদাই। অহোরাত্র। কেমন একটা ব্যঙ্গ হাসির সঙ্গে বলে মল্লিকা।
প্রভাত বলে, এত কী কাজ? লোকজন তো রয়েছে?