কতদিন আছেন আপনি এখানে?
ওঃ, সে কি আজ? রাগ করে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম ধুত্তোর বাংলা দেশ! তারপর কোথা দিয়ে যে কি হল? এখানেই
দেশে আর কখনো যাননি?
চ্যাটার্জি একবার তীব্র কটাক্ষে প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। নিছক সরল কৌতূহল, না আর কিছু?
নাঃ, সরল বলেই মনে হচ্ছে। বোকা প্যাটার্নের ছেলেটা!
বলেন, গিয়েছিলাম। একবার বাপ মরতে গিয়েছিলাম, আর একবার বিধবা বোনটা মরতে বাচ্চা ভাগ্নিটিকে কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছি। ব্যস, সেই অবধি।
প্রভাত হাসে, কিন্তু এমন নিখুঁত বাঙালী রয়ে গেছেন কী করে বলুন তো? এতদিন বাইরে থাকলে লোকে তো
বলেন কি মশাই, বাঙালীর ছেলে বাঙালী থাকব না? যাক, তাহলে অসুবিধে কিছু নেই?
না না, মোটেই না। আপনার বোর্ডিংয়ের নামকরণ সার্থক!
চ্যাটার্জি একটু মিষ্ট-মধুর হাসেন, হাঁ, সকলেই অনুগ্রহ করে ওকথা বলে থাকেন। ক্রমশই বুঝবেন, কেন নিজের এত গৌরব করল চ্যাটার্জি। এ তল্লাটে আরাম কুঞ্জ বললে চিনবে না এমন লোক নেই। আর ওই যা বললাম, একবার যিনি পায়ের ধুলো দিয়েছেন
প্রভাত সসঙ্কোচে বলে, কিন্তু আমাকে যে এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে হবে। মানে যতদিন না ফের বদলি হচ্ছি।
কি আশ্চর্য! থাকবেন তার চিন্তার কি আছে? চ্যাটার্জি মুচকে হাসেন, দেখবেন, এখান থেকে আর বদলি হতেই চাইবেন না। তবে শুনুন চ্যাটার্জি চুপি চুপি বলেন, স্থায়ী বোর্ডারদের চার্জ অনেক কম। ব্যবসা করেছি বলে তো আর আক্কেলের মাথা খেয়ে বসিনি মশাই। বিবেচনাটা আছে। দেখবেন ক্রমশ চ্যাটার্জির বিবেচনায় ত্রুটি পাবেন না।
.
স্থায়ী বোর্ডারদের চার্জ অনেক কম– এই আশ্বাসবাণীটি হৃদয়ে মধুবর্ষণ করতে থাকে। হৃষ্টচিত্তে প্যাড টেনে নিয়ে চিঠি লিখতে বসে প্রভাত।
মাকে লেখে, কাকাকে লেখে।
মাকে লেখে–মা, তোমাদের কাছ থেকে আরও অনেক দূরে চলে এসেছি। আসবার সময় মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অজানা জায়গা–কোথায় থাকব, কি করব। কিন্তু ভাগ্যক্রমে স্টেশন থেকেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। একটি বাঙালীর হোটেল পেয়েছি, বাঙালী রান্নাও খেলাম। ঘর নতুন, সুন্দর সাজানো, বাড়ীটি ছবির মতন, আর জায়গাটা এত চমৎকার যে, ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের সকলকেই দেখাই। ঘরের পিছনের বারান্দায় বসলে যতদূর চোখ চলে, যাকে বলে মুক্ত প্রান্তর, আর তার ওপারে পাহাড়। পরে আবার চিঠি দেব। প্রভাত।
কাকাকে লিখল, কাকা, তোমাদের কাছ থেকে এসে মন-কেমন করছে, একথা লিখতে গেলে ছেলেমানুষী হবে, তাই আর লিখলাম না। থাকার খুব ভালো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পরে আবার
চিঠি দিচ্ছি। তুমি ও কাকীমা প্রণাম জেনো। আমার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থেকো। কাকীমাকে বলো, জায়গাটা খুব সুন্দর।
ইতি–প্রভাত।
দুজনকেই জানাতে উদ্যত হচ্ছিল, মল্লিকার মত একটি মেয়েকে এরকম জায়গায় দেখতে পাওয়ার বিস্ময় বোধটা কিন্তু কিছুতেই ভাষাটা ঠিকমত মনে এল না। ভাবল, যাকগে, কী আর এমন একটা খবর!
ভাবল কিন্তু সেই কী আর এমনটাই মনের মধ্যে একটা খবরের মত কানাকানি করতে থাকল!
সত্যি, আশ্চর্য! এ ধরনের বাঙালী পরিবার পরিচালিত হোটেল, এখানে দেখতে পাওয়া অভাবনীয়। পুরীতে কাশীতে রাঁচিতে এখানে সেখানে দেখেছে প্রভাত, যতটুকু যা বেড়িয়েছে। অথচ ঠিক এ রকমটি কিন্তু দেখেনি। পাঞ্জাবের এই দূর সীমান্তে, শহর ছাড়ানো নির্জনতায়!
কিন্তু রাত্রে যেন নির্জনতাটা তেমন নির্জন রইল না। সারাদিনের ক্লান্তি আর গত রাত্রের ট্রেনের রাত্রিজাগরণ দুটো মিলিয়ে প্রভাতকে তাড়াতাড়ি বিছানা নেবার প্রেরণা দিচ্ছিল, তাই গণেশকে ডেকে প্রশ্ন করল, এখন খেতে পাওয়া যাবে কিনা।
গণেশ মৃদু হেসে জানাল, এখানে পাওয়া যাবে কিনা বলে কোনও কথা নেই। রাত দুটো তিনটেতেও লোক আসে, খাওয়া-দাওয়া করে।
প্রভাত সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে, অতরাত্রে লোক? তখনও কোনো ট্রেন আসে নাকি?
গণেশ আর একটু ব্যঞ্জনাময় হাসি হেসে বলে, ট্রেন আসে কিনা জানি না বাবু। লোক আসে তাই জানি। তেমন হলে আমাদের তো আর রাতে ঘুমোবার জো থাকে না। শীতের রাতে হি হি করতে করতে
ওরে বাবা! এখানের শীত! প্রভাত পুনঃপ্রশ্ন করে, তুমি তো বাঙালী?
তা হবে।
তা হবে! কৌতুক অনুভব করে প্রভাত গণেশের কথায়। বলে, তা হবে মানে? নিজে কোন্ দেশের লোক জানো না?
জানার কি দরকার বাবু! ভূতের আবার জন্মদিন! আপনার খাবার আনছি।
প্রভাত ভাবল খাবার কি গণেশই আনবে? অন্তত তার সঙ্গে আর কেউ আসবে না?
নাঃ, এলও না।
গণেশ এল। তার সঙ্গে একজন অবাঙালী বয়।
পরিষ্কার কাঁচের পাত্রে, পরিষ্কার ন্যাপকিন। আহার্যের সুবাসে যেন ক্ষিদে বেড়ে ওঠে প্রভাতের।
কাকার বাড়ীর নিত্য ডালরুটির ব্যবস্থার পরই এই রাজকীয় আয়োজনটা প্রভাতকে একটু ঔদারক মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই।
তবু খেতে খেতে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল প্রভাত, ইচ্ছে করে একটু দেরি করে খেতে লাগল। যদি তদ্বিরকারিণী একবার এসে উদয় হয়।
না, প্রভাতের আশা সফল হল না!
অদৃশ্য একটা কর্মজগতের উপর কেমন একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা অনুভব করল প্রভাত। এত কাজ! বাবাঃ!
বিছানায় পড়তে না পড়তেই ঘুম আসবার কথা, কিন্তু কিছুতেই যেন সে ঘুমটা আসছে না। উঁকি দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে।