মল্লিকা কিন্তু করুণাময়ীর বকবকানিতে কান করে না। নির্দিষ্ট নিয়মে ওঁর হাত থেকে গঙ্গাজলের ঘটি আর ভিজে কাপড় গামছাটা নেয়। উঠোনে নেমে কাপড়খানা শুকোতে দিয়ে আসে টানটান করে। বলে, আপনার উনুনে আগুন দিই?
দিও দিও। আগে একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিই। ভারী তো রান্না, আপনার একলার আবার রান্না! একপাকে ফুটিয়ে নেব।
কথাটা অবশ্য তেমন সমূলক নয়।
একলার জন্যে সাতখানি রাঁধেন করুণাময়ী। যদিও ছুতোটা করেন প্রভাত আমার ভালবাসে। টুকটুক করে রাখেনও সেসব প্রভাতের জন্য গুছিয়ে।
রাত্রে প্রভাতকে খেতেই হয় সেই সুক্ত, পোস্তর বড়া, মোচাহেঁচকি, কচুরশাকের ঘণ্ট।
.
হ্যাঁ, এমনিই সব পাঁচখানা রাঁধবেন এখন করুণাময়ী। আর মল্লিকাকে বসে থাকতে হবে তার জোগাড় দিতে। গঙ্গাস্নানে যাবার আগে মল্লিকাকে খাইয়ে আমিষ হেঁসেলের পাট চুকিয়ে যান করুণাময়ী। তিনি নিজে যখন খান, তখন জলখাবারের সময় হয়ে যায় মল্লিকার। করুণাময়ীর খুব ইচ্ছে হয় আর একদফা ভাতই খাক ছোট বৌ, শাশুড়ির অনবদ্য অবদান দিয়ে, কিন্তু ভাত খেতে চায় না বৌটা। একবেলাই খেতে নারাজ তা দুবেলা! পশ্চিমে মানুষ তো, মোটা মোটা। রুটি গিলে মরেছে চিরকাল।
.
রান্নার জায়গায় দৃষ্টিপাত করে করুণাময়ী বলে ওঠেন, মেতির শাক কটা রেখে গিয়েছিলাম, কই বেছে রাখনি ছোট বৌমা?
শাক!
মল্লিকা যেন ভেবে মনে আনতে চেষ্টা করে শাক বস্তুটা কি! যাত্রাকালে কি যেন একটা বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী, সে কি ওই শাকের কথা?
কিন্তু না, বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী অন্য কথা। শাকটা রেখেছিলেন ছোট বৌমার বিবেচনাধীনে। যার বিষয়ে বলে গিয়েছিলেন তার দিকে নজর পড়তেই শিউরে ওঠেন, কি সর্বনাশ! সেই কাঁচা আমের কাড়ি ছায়ায় পড়ে আছে? রোদের দিকে টেনে দাও নি ছোট বৌমা? ছি ছি! মন তোমাদের কোন দিকে থাকে বাছা! অত করে বলে গেলাম!
নিজেই হিঁচড়ে টেনে আনেন তিনি ঝুড়িটা।
মল্লিকার মনে পড়ে এই কথাটাই বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী।
কিন্তু মল্লিকার চিন্তাজগতে কাঁচা আমের ঝুড়ির ঠাই কোথায়? করুণাময়ী সেই কথাই বলেন।
বলেন, তোমার তো সবই ভাল ছোট বৌমা, এই ভুলটাই একটা রোগ। মাথাটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা কর দিকি!
মল্লিকা উঠোনে এসে পড়া ভরদুপুরের প্রখর রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলে, করব।
করুণাময়ী বলেন, হ্যাঁ তাই বলছি। সন্ধ্যেবেলায় সিনেমা না থিয়েটার কোথায় যেন যাবে শুনলাম। তা আমি তো তখন পাঠবাড়ীতে যাব। দোরজানলা সব ভালো করে বন্ধ করে সদরে তালা লাগিয়ে চাবিটা ও বাড়ি রেখে যেও। আমিই যদি আগে আসি!…ভালো করে মনে রেখো, কি জানি তখন কোন মতলবে ঘুরছিল লোকটা। এই যে তোমরা সন্ধ্যেবেলা বাড়ী থাকবে না, জেনেছে হয়তো কোন ফাঁকে। তালায় চাবিটা লাগিয়ে তালা টেনে দেখে তবে বেরিও।
সাবধানের ত্রুটি করেন না করুণাময়ী। তার জানার জগতে যেসব সাবধানতা আছে, তার পদ্ধতি শিক্ষা দেন তাঁর অবোধ ছোট বৌকে।
কিন্তু দরজা কি শুধু ঘরেই থাকে?
আর সে দরজায় চাবি লাগাতে পারলেই সমস্ত নিরাপদ?
.
প্রভাত আসছিল ভারি খুশী খুশী মনে।
আজ একটা সুখবর পাওয়া গেছে অফিসে। বেশ কিছু মাইনে বেড়েছে।
ভাবতে ভাবতে আসছিল, বাড়ি গিয়ে মল্লিকাকে বলবে, রাতে আজ খুব ভালো করে সাজতে হবে তোমায় মল্লিকা! সেই তোমার ফুলশয্যার শাড়িটা পরবে, খোঁপায় জড়াবে রজনীগন্ধার মালা, কপালে চন্দনের লেখা। তোমায় দেখব বসে বসে।
কিন্তু বাড়ি এসে সে কথা বলবার আর ফুরসই পেল না বেচারা প্রভাত গোস্বামী। ওই : সৌখিন কবিত্বটুকু ফলাবার আগেই চোখ ঝলসে গেল তার।
অপরূপ সাজসজ্জায় ঝলমলিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল মল্লিকা।
পরনে পাতলা জরিদার শাড়ি। রজনীগন্ধার মালা জড়ানো শিথিল কবরী নয়, সাপিনীর মত কালো চকচকে জরি-জড়ানো লম্বা বেণী।
ঠোঁটে গাঢ় রক্তিমা, নখে রঙের পালিশ। গালেও বুঝি একটু কৃত্রিম রঙের ছোঁয়াচ। সুর্মাটানা চোখে কেমন একটু বিলোল কটাক্ষ হেনে বলে, কেমন দেখাচ্ছে?
খুব কি ভাল লাগে প্রভাতের? লাগে না। তবু
প্রভাত হাসে, আর বলে, বড় বেশি রূপসী: একটু যেন ভয় ভয় করছে।
ভয়!
তাই তো! পথে নিয়ে বেরোতে সাহস হচ্ছে না।
.
কিন্তু প্রভাতের সেই তুচ্ছ কৌতুকের কথাটুকু কি কোনও ক্রুর ভাগ্যদেবতাকে নিষ্ঠুর কৌতুকের প্রেরণা দিল? তাই ভয় এল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে! লুটে নিয়ে গেল প্রভাতের জীবনের রং, ঈশ্বরের বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা।
সিনেমা হল থেকে প্রভাতের বাড়ি ফিরতে এই পথটা একটু গা-ছমছমে বটে। এরই আশেপাশে নাকি হাওড়ার বিখ্যাত গুণ্ডাপাড়া।
কিন্তু সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখে তো আগেই ফিরেছে প্রভাত আর প্রভাতের পাড়ার লোকেরা।
দুদিন আগেও লাস্ট শোয়ে ছবি দেখে এসেছে প্রভাতের মেজদা মেজবৌদি
তবু পাড়ার লোক আর জ্ঞাতিগুষ্ঠী ধিক্কার আর ব্যঙ্গের স্রোত বহালো।
হবেই তো! সুন্দরী রূপসী বৌকে সঙ্গে করে রাত নটায় গুণ্ডাপাড়া দিয়ে…ছি ছি, এত কায়দাও হয়েছে একালের ছেলেদের!…হল তো, বৌকে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল, ভ্যাকা হয়ে দেখলি তো দাঁড়িয়ে?…হ্যাঁ, তবু রক্ষে যে তোকে খুন করে রাস্তায় শুইয়ে রেখে যায়নি!…
আবার একথাও বলল, পাড়া কি এত নিশুতি হয়ে গিয়েছিল সত্যি যে অতবড় কাণ্ডটা কারুর চোখে পড়ল না, এতখানি চেঁচামেচি কারুর কানে গেল না?…ভয়ানক একটা চেঁচামেচি ধস্তাধস্তি তো হয়েছে নিশ্চয়ই।