সবাই যা করে? মল্লিকা নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে বলে, সেটা কি?
ধর সিনেমা গেলাম। ওতে আর কেউ নিন্দে করতে আসবে না। নিজেরা তিনবেলা দেখছে সবাই।
সিনেমা! ওঃ!
কেন, পছন্দ হল না?
পছন্দ? হঠাৎ হেসে ওঠে মল্লিকা। যেমন হঠাৎ হাসিতে মাঝে মাঝে চমকে দেয় প্রভাতকে–তেমনি চমকে দেওয়া হাসি। হেসে বলে, সে কী! পছন্দ হবে না কি বল? বরের সঙ্গে সেজেগুজে সিনেমা যাব, এর থেকে পছন্দসই আর কি আছে?
তাহলে রাজী?
নিশ্চয়।
একেবারে টিকিট কেটে নিয়ে আসব তাহলে? আর যতটা সম্ভব সকাল সকাল আসব। তুমি কিন্তু একেবারে ঠিক হয়ে থেকো! ওই যা বললে–সেজে-গুঁজে একটু থেমে বলে, মাকে একটু তাক বুঝে, মানে আর কি মুড বুঝে জানিয়ে রেখো, কেমন?
সেটা তুমিই রেখে যাও না?
আমি? আচ্ছা আমিই বলে যাব। বলে বটে, তবে এই ভাবতে ভাবতে চান করতে যায়, মার মুডটা পাব তো? পেতেই হবে। রান্নার সুখ্যাতি করতে হবে প্রথমে, তারপর একটু ভাত চেয়ে নিয়ে খেতে হবে। তাহলেই
ছোট সুখ, ছোট ভাবনা। নিতান্ত তুচ্ছতা দিয়ে ভরা বাংলার তেলেজলে কাদায় মাটিতে গড়া অতি সাধারণ প্রভাত গোস্বামী।
আশ্চর্য যে, এই প্রভাত গোস্বামীই সেই হাজার মাইল দূরের দুর্ধর্ষ বাঘের গুহা থেকে তার মুখের গ্রাস চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল।
কি করে পেরেছিল?
জল হাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতি, এরাই কি মানুষকে ভাঙে গড়ে? আসলে মানুষের নিজস্ব কোনও আকার নেই? মাটি আর হাওয়া তাকে বীর করে, কাপুরুষ করে, ভীরু করে, বেপরোয়া করে?
কিন্তু তাই কি?
যাইহোক আপাতত আজকে প্রভাত খুব একখানা সাহসী পুরুষের ভূমিকা অভিনয় করল। মাকে সোজাসুজি বলল, মা, ওবেলা একটু সকাল সকাল আসব। সিনেমা যাব।
করুণাময়ী অবশ্য এ সংবাদে প্রীত হলেন না। হনও না। বিরসকণ্ঠে বলেন, সিনেমা? এই তো কবে যেন গেলি?
আরে সে তো কতদিন!
তা বেশ যাবে যাও। রাত করে ফেরা, বৌকে নিয়ে একটু সাবধানে ফিরো। দিনকাল খারাপ!
কী মুশকিল! দিনকালের আবার কি হল?
হল নাই বা কেন? এই তো মেজবৌমা কাল বলছিল, দুপুরের ফাঁকে নাকি একটা সা জোয়ান মত লোক আমাদের আমবাগানের ওদিকে ঘোরাঘুরি করছিল।
করছিল! অমনি! তোমার ওই মেজবৌমাটি হচ্ছেন এক নম্বরের গুজব-সাম্রাজ্ঞী।
না না। ও বলল পষ্ট দেখেছে। বলল তার নাকি ভাব-ভঙ্গী ভাল নয়।
প্রভাত হেসে উঠে বলে, অতিরিক্ত রহস্য সিরিজ পড়লেই এইসব দিবাস্বপ্ন দেখে লোকে। রাস্তা দিয়ে একটা লোক হেঁটে গেল, উনি তার ভাবভঙ্গী অনুধাবন করে ফেললেন। যত সব!
মেজবৌদির কথাকে চিরদিনই উড়িয়ে দেয় প্রভাত, আজও দিল।
তবে কিছুদিন আগে হলে হয়তো দিত না, দিতে পারত না। যখন সদাসর্বদা ভয়ঙ্কর একটা আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল তার ছায়াসঙ্গী।
মল্লিকাকে নিয়ে আসার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত এমন ছিল। তখন মেজবৌদি এমন সংবাদ পরিবেশন করলে হয়তো হেসে ওড়াতে পারত না প্রভাত। ভয়ে সিঁটিয়ে উঠত।
চাটুয্যে এসে দেখা-সাক্ষাৎ করে যাবার পর থেকে সেই ভয়টা দূর হয়েছে প্রভাতের। আতঙ্ক আর তার ছায়াসঙ্গী নেই। বুঝেছে চাটুয্যের দ্বারা আর কোনও অনিষ্ট হবার আশঙ্কা নেই তাদের। মল্লিকার সুখ-সৌভাগ্য দেখে মন পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার মামার। স্নেহের কাছে স্বার্থ পরাস্ত হয়েছে।
অতএব আবার পুরনো অভ্যাসে মেজবৌদির বৃথা ভয় দেখানোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলে। মা যে ততটা ভুরু কোঁচকান নি, এতেই খুশীর জোয়ার বয় মাতৃগতপ্রাণ প্রভাতের। দাদাদের আর বৌদিদের দুর্ব্যবহারে বিক্ষত মাতৃহৃদয়ে, সদ্ব্যবহারের প্রলেপ লাগাবার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে প্রভাত সেই কবে থেকে! তাই না মাকে এত মেনে চলা।
হুট করে মল্লিকাকে নিয়ে আসায় তাতে একটা ছন্দপতন হয়েছিল বটে, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছেয় আর প্রভাতের আপ্রাণ চেষ্টায় সে ছন্দ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিল অবশেষে।
করুণাময়ী ঈষৎ অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, সে যাই হোক, সাবধানের মার নেই।
আচ্ছা বাপু আচ্ছা, যতটা পারব সাবধান হব।
অফিসে বেরিয়ে পড়ে প্রভাত।
খানিক পরেই গঙ্গাস্নান ফেরৎ আসেন করুণাময়ী একটু যেন হন্তদন্ত হয়ে। ডাক দেন। ছোটবৌমা, ছোটবৌমা!
মল্লিকা দোতলা থেকে নেমে আসে।
করুণাময়ী ব্যস্তভাবে বলেন, নীচেরতলায় বাগানের দিকের ঘরে ছিলে তুমি?
মল্লিকা নির্লিপ্তভাবে বলে, কই না তো! এই তো নামলাম ওপর থেকে। কেন?
বাঁশঝাড়ের ওদিক থেকে হঠাৎ মনে হল কে যেন ওই ঘরের জানলার নীচে থেকে সরে গেল! কাল মেজবৌমাও বলছিল। দেখ দিকি ঘরের কোনও জিনিস খোয়া গেছে কিনা। আমাদের পাঠবাড়ীর গিন্নীর তো সেদিন জানলা দিয়ে এক আলনা কাপড় চুরি গেল। যেমন বুদ্ধি, জানলার কাছে আলনা! আঁকশি দিয়ে দিয়ে বার করে নিয়ে গেছে। তোমার এ ঘরে
না, নীচের ঘরে তো আমার কিছু থাকে না।
কথাটা ঠিক। কোন কিছুই থাকে না ও ঘরে। নেহাৎ সংসারের বাড়তি ডেয়োটকনা বোঝাই থাকে। জানলা দিয়ে আঁকশি চালিয়ে বার করে নিয়ে যাবার মাল সে সব নয়।
তত্রাচ করুণাময়ী একবার সে ঘরে ঢোকেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাস করেন। জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলেন, সন্দেহ হচ্ছে কোনও চোরাচোড় তক্কে তক্কে ফিরছে। কাল মেজবৌমার কথায় কান দিইনি, আজ প্রভাতও সে কথা হেসে ওড়ালো, কিন্তু এ আমার নিজের চোখ, অবিশ্বাস করতে পারি না। কেমন যেন হিন্দুস্থানী মতন একটা লোক