ঝড়ের শব্দে ওর কথার শব্দ ডুবে গেল।
ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে এল প্রভাত।
দেখল দুরন্তবেগে মল্লিকার চুল উড়ছে, আঁচল উড়ছে, মল্লিকা জানলার শিক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে মাথায় সেই ঝড় খাচ্ছে।
কী হচ্ছে? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
মল্লিকা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না।
প্রভাত দাঁড়াতে পারছিল না এই উত্তালের মুখে, তবু দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরল, ছাড়িয়ে নিতে গেল শিক থেকে কপাট বন্ধ করবে বলে। কিন্তু বড় দৃঢ়মুষ্টি মল্লিকার।
মল্লিকা, এ কী সখ? চোখে মুখে ধূলো ঢুকে মারা যাবে যে! নিজে ধূলোর ভয়ে চোখ বুজে মাথা নীচু করে বলে প্রভাত, দোহাই তোমার, জানলার কাছ থেকে সরে এসো।
সহসা ঘুরে দাঁড়ায় মল্লিকা। কঠিন গলায় বলে, না।
না!
হ্যাঁ। হ্যাঁ। তুমি যাও। অন্য ঘরে চলে যাও। জানলা দরজা বন্ধ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোও গে। নয়তো মার আঁচলতলায়। সেই তোমার উপযুক্ত ঠাই।
মল্লিকা!
মল্লিকা আবার ফিরে দাঁড়িয়েছে বাইরের দিকে মুখ করে। বন্যপশুর আর্তনাদের মত একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, প্রভাত দাঁড়াতে পারছে না।
প্রভাত দাঁড়াতে পারে না।
তবু ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। বলে, মল্লিকা, অসুখ করবে।…মল্লিকা, বাইরে থেকে কিছু ছিটকে এসে চোখে মুখে লেগে বিপদ ঘটাবে।
মল্লিকা নিরুত্তর।
আর পারে না প্রভাত।
বেশ যা খুসি কর। বলে সত্যিই পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
ভাবে, আশ্চর্য! অদ্ভুত! এক এক সময় কী যে হয় ওর!
ওদের বংশে কেউ কি পাগল ছিল? শরীরে সেই রক্তকণিকা বহন করে রয়েছে বলেই মাঝে মাঝে উন্মত্ততা জাগে ওর?
কখন যে ঝড় কমেছে, কখন যে তার আর্তনাদ থেমেছে, খুব স্পষ্ট মনে নেই প্রভাতের, শুধু মনে আছে অনেকক্ষণ ঘুম আসে নি। আর একবার ও ঘরে গিয়ে চেষ্টা করেছিল মল্লিকাকে জানলা থেকে সরাতে পারে নি।
ঘুম ভাঙল প্রভাতের অনেক বেলায়। তাড়াতাড়ি এঘর থেকে শোবারঘরে গিয়ে দেখল, ঘর খালি। দেখে নীচে নেমে এল। আর নেমে এসে যে দৃশ্য দেখল, তাতে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না।
নীচের দালানে বড় একটা ধামা ভর্তি ঝড়ে পড়া কাঁচা আম করুণাময়ী তার থেকে বেছে বেছে এগিয়ে দিচ্ছেন, আর মল্লিকা সেগুলো নিয়ে দ্রুতহস্তে ছাড়াচ্ছে।
এ কী কাল রাত্রের সেই মল্লিকা?
মল্লিকা কি বহুরূপী? নাকি মাঝে মাঝে মল্লিকার উপর ভূতের ভর হয়?
কিন্তু মা সামনে, তাই সম্বোধনটা মল্লিকাকে করা চলে না, আবেগ আবেগ গলায় মাকেই বলে, মা, কাল সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে তুমি বাগানে নেমেছিলে?
আমের সঞ্চয়ে পুষ্ট এবং বাহাদুরিতে হৃষ্ট করুণাময়ী হেসে বলেন, না নামলে? ঝড় থামার অপেক্ষায় থাকলে একটা আম চোখে দেখতে পেতাম? রাজ্যের ছোঁড়াছুঁড়ি এসে বাগান বেঁটিয়ে নিয়ে চলে যেত না?
সে তো বুঝলাম। কিন্তু গেলে কি করে?
কি করে আবার? যেমন করে ফি বছর যাই। তোর বৌদিরা তো আবার এদিকে অহঙ্কারের রাজা, ঠেকার করে একটা আম নেয় না, এদিকে তোর বড়দা মেজদার স্বভাব তো জানিস? আচার নইলে ভাত মুখে রোচে না। তা এই কাঁচা আমের সময়
প্রভাত হেসে ওঠে।
এদিকে তো বড় মেজ পুত্তুরের সাতশো নিন্দে না করে জল খাও না, অথচ তাদের মুখরুচির দায়ে প্রাণের ভয় তুচ্ছজ্ঞান করে রাতদুপুরে ঝড়ের মুখে ছোটো আম কুড়োতে! তাজ্জব!
করুণাময়ীর মন আজ প্রসন্ন। তাই এ কথায় অভিযোগ অভিমানের দিক দিয়ে না গিয়ে হেসে বলেন, তা তাজ্জব বটে। বুঝবি এরপর এর মানে। আগে ছেলের বাপ হ।
প্রভাত লজ্জায় লাল হয়।
গোপন কটাক্ষে একবার মল্লিকার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু সে মুখে কোনও বর্ণবৈচিত্রের খেলা দেখতে পায় না। সে যেমন আনত মুখে হাত চালাচ্ছিল তেমনি চালাতেই থাকে।
অনেকক্ষণ পরে অন্তরালে দেখা হয়।
আস্তে বলে, রাতের ভূত ঘাড় থেকে নেমেছে?
মল্লিকাও আস্তে উত্তর দেয়। কিন্তু সেই মৃদুতার মধ্যে যেন অনেক যোজন দূরত্ব। মজবুত ইস্পাতের কাঠিন্য।
ভূত কি ঘাড় থেকে সহজ নামে?
প্রভাত এই দূরত্বের কাছে একটু যেন অসহায়তা বোধ করে, তাই জোর করে সহজ হতে চায়। বলে, তুমি তো দেখি ইচ্ছে করলেই ভূতকে ঘাড়ে তুলতে পারো, ঘাড় থেকে নামাতেও পারো। সত্যি, মাঝে মাঝে কী যে হয় তোমার!
কী হয়, সে সম্বন্ধে কি মনে হয় তোমার!
কী মনে হয় আসলে জানো? তুমি বড্ড বেশি সিরিয়াস। জীবনটাকে অত ভারী ভাববার দরকারই বা কি? ইচ্ছে করলেই তো হালকা করে নেওয়া যায়, সহজ করে নেওয়া যায়।
সবাইয়ের পক্ষে হয় তো তা যায় না।
ওটা ভুল। হালকা হব ভাবলেই হালকা হলাম, এর আর কি? চলো আজ সন্ধ্যায় কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা যাক। একঘেয়ে বাড়ি বসে থেকে থেকে–
মল্লিকা তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলে, বেড়াতে? কোথায়? হাওড়া-ময়দানে?
হাওড়া-ময়দানে!
তা ছাড়া আর কোথায়? লোকালয়ে গেলেই তো নিন্দে। সেদিন একটু লাইব্রেরিতে গিয়েই তো—
প্রভাত একথা বলতে পারে না, তোমার আচরণে যে কেমন একটা ব্যালেন্সের অভাব মল্লিকা, তাই তো নিন্দে হয়। সেদিন লাইব্রেরিতে তুমি যে কী অদ্ভুত মাত্রাছাড়া বাঁচালতা করলে! বলতে পারে না। শুধু বলে, আমাদের এই জায়গাটা কলকাতা শহরের প্রবেশপথ হলে কি হবে, বড্ড বেশি ব্যাকওয়ার্ড যে! একটুতেই নানা কথা। কথার সৃষ্টি করে লাভ কি বল? তার চেয়ে সবাই যা করে তাই করাই ভাল নয় কি?