.
এ অপমানে গুম হয়ে গেলেন করুণাময়ী, এ সংবাদে আহত। ভাবলেন, বলতে হবে প্রভাতকে। তাঁর অবশ্য বান্ধবীর মত অবস্থা নয়। কারণ তার বৌ ঠিক শাস্ত্রসম্মত সাধ্বীসতী নয়। সে অত ছায়ার মত বরের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে না। বরং একটু খামখেয়ালি মত। আছে তো আছে, নেই তো নেই। হয়তো বাগানেই ঘুরে বেড়ালো, হয়তো পুকুরঘাটে গিয়েই বসে থাকল, হয়তো ছাতেই উঠে গেল।
তবে পরিমলটা বড্ড আসতে সুরু করেছে। বয়সের ধর্ম আর কি! যেখানে রূপযৌবন, সেখানেই আকর্ষণ। বৌদিদি যে তোর থেকে পাঁচ-সাত বছরের বড়, তাও হিসেব নেই। যাক, ছেলেকে বৌয়ের আওতার বাইরে পাওয়া করুণাময়ীর পক্ষে শক্ত নয়।
ভাবলেন সবই বলবেন।
.
বলবেন বলেই ছেলেকে খুঁজছিলেন, ছেলেই তাকে খুঁজে বার করল এসে। রুদ্ধকণ্ঠে বলল– মা, মল্লিকা কই?
মায়ের সামনে এমন নাম করে উল্লেখ করে না প্রভাত, বলে, তোমার ছোট বৌ। মল্লিকা শুনে চমকে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন করুণাময়ী। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন? ঘরে নেই?
না তো।
ছাতে গিয়ে বসে আছে তাহলে।
না না, দেখেছি।
তা অত অস্থির হচ্ছিস কেন? মেজ বৌমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছে হয়তো।
না মা, না। সব জায়গায় খোঁজ করেছি।
শোন কথা। কর্পূর নাকি যে উপে যাবে। ঘাটে দেখেছিস?
ঘাটে! সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে, এখনো ঘাটে?
তা আশ্চয্যি নেই। আজকাল তো ওইরকম খামখেয়ালীই হয়েছে। প্রথম প্রথম কী শান্ত, কী নরম, কী ভয় ভয় লজ্জা লজ্জা ভাব দেখাল, ক্রমেই যেন বিগড়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে। তোমাদেরও যেমন আদিখ্যেতা হয়েছে আজকাল! সখ করে বৌকে রাজ্যির বেটাছেলের সঙ্গে মিশতে দেওয়া! আরে বাবা, ওতে বৌ-ঝি বারচকা হয়ে যায়। ঘরতলায় মন বসে না। কাল তো শুনলাম
কিন্তু কি শুনছেন, সে কথা কাকে আর শোনাবেন করুণাময়ী?
শ্রোতা তো ততক্ষণে টর্চ হাতে ঘাটের পথে হাওয়া!
.
হ্যাঁ করুণাময়ীর অনুমানই ঠিক।
ঘাটের ধারেই বসে আছে মল্লিকা। কিন্তু একাই কি বসে ছিল? না টর্চের ক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রভাতকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে?
এমন সময় এখানে কেন? এ প্রশ্ন না করে প্রভাত বলে ওঠে, এখানে কে ছিল?
এখানে? হঠাৎ উদ্দাম একটা হাসিকে অদূরবর্তী বাঁশবাগানের ঝোড়ো হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় মল্লিকা।
এখানে ভূত ছিল। তোমার পদশব্দে ভয় খেয়ে পালাল।
প্রভাত বসে পড়ে বাঁধানো ঘাটের পৈঠেয়। বলে, এমন সময় এখানে কী?
মাছ ধরছি।
মাছ ধরছ?
হু গো। দেখ না এই চার, এই ছিপ, এই বঁড়শি—
নাঃ একেবারে ছেলেমানুষ! কী যে ভাবছিল প্রভাত!
সহসা প্রভাতও হেসে ওঠে। বলে, একটি বৃহৎ রোহিত মৎসের গলায় তো জন্মের শোধ বঁড়শি গিঁথেছ, আবার কেন?
মল্লিকা আবার হেসে উঠে বলে, কে কার গলায় বঁড়শি গেঁথেছে, কে কাকে ছিপে তুলেছে, সেটা বিচারসাপেক্ষ। নইলে আর রাতের মাছ অসাবধানে বেড়ালে খেয়ে গেছে বলে সন্ধ্যেবেলা মাছ ধরতে আসতে হয়?
এই ব্যাপার! ছি ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যায় প্রভাতের।
এমনি ছেলেমানুষ, আর এমন প্রেমে বিভোর স্ত্রীকে সে কিনা সন্দেহ করছিল? ভাবছিল বাড়ীতে আসতে বারণ করেছে বলে পরিমলটা হয়তো পুকুরঘাটে এসে জুটেছে, আর সময়ের জ্ঞান ভুলে আড্ডা হচ্ছে। খেয়ালই নেই যে অফিস থেকে ফেরার সময় উৎরে গেছে প্রভাতের।
নাঃ, পাঁচজনের পাঁচকথায় মনটা বিগড়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পথে ফট করে এমন একটা কথা বলল মেজদা! তাই না ঘরে এসে বৌকে দেখতে না পেয়েই অমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল প্রভাত।
কাকতালীয় ব্যাপার এইভাবেই ঘটে।
নইলে মল্লিকা যখন প্রভাতের খাওয়ার অসুবিধে নিরাকরণ করতে একটা বেপরোয়া ছেলেমানুষী করছে বসে, প্রভাত তখন এক তীব্র সন্দেহে নিজেকে জর্জরিত করছে।
না না।
এখানে কেউ ছিল না। টর্চের আলোর বিভ্রান্তি। গাছপালার ছায়া। বাঁশপাতার সরসরানি।
বড় অন্যায় হয়ে গেছে। মল্লিকা প্রভাতের মন জানতে না পারুক, প্রভাত তো নিজে জেনেছে। বোধ করি অপরাধস্থালন করতেই আদরে ডুবিয়ে দেয় প্রভাত মল্লিকাকে।
কেড়ে রেখে দেয় ছিপ হুইল বঁড়শি। বলে, থাক আর মাছে কাজ নেই, খাবার জন্যে আরও ভাল জিনিস আছে।
করুণাময়ী ছেলের দেরি দেখে উদ্বিগ্নচিত্তে পিছু পিছু আসছিলেন, লজ্জায় ঘেন্নায় গরগর করতে করতে ফিরে যান। ততক্ষণে একটু একটু জ্যোৎস্না উঠেছে, কাজেই দৃশ্যটা একেবারে অদৃশ্য নয়।
.
যে সন্ধ্যায় জ্যোৎস্না উঠেছিল সেই সন্ধ্যায় ঝড় উঠল। কাঁচা আম ঝরানো তোলপাড় করা ঝড়।
হঠাৎ আচমকা।
জানলা দরজা আছড়ে পড়ে, দেওয়ালে টাঙানো ছবি দড়ি ছিঁড়ে পড়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়। পরে শুকোতে দেওয়া কাপড় ফস্ করে উড়ে গিয়ে পাক খেতে খেতে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয় কে জানে।
দরজার মাথার তাকে সাজানো পুতুল পড়ল গড়িয়ে, সাঙা থেকে লক্ষ্মীর আঁপি কড়ির কৌটো ছিটকে ধূলোয় লুটোল।
আমবাগান আর বাঁশবাগানে চলতে লাগল যেন ক্ষ্যাপা অসুরের রাগী লড়াই।
.
এ ঝড়ের মধ্যে বুঝি সেই দূর অরণ্যের আছড়ানি, দূর সীমান্তের হাতছানি। এ ঝড়ে অনেক দূরের রোমাঞ্চ আর অনেক দিনের ভুলে যাওয়া মদের স্বাদ।
জানলাগুলো সব খুলে দেয় মল্লিকা।
প্রভাতের ঘুম গভীর। প্রথমটা জাগে নি, হঠাৎ ছবি পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল। চমকে উঠে বসে বলল, কী সর্বনাশ! ও কি? জানলা খোলা কেন? বন্ধ কর, বন্ধ কর।