খুবই স্বাভাবিক যে মল্লিকা আহত হবে, বিচলিত হবে।
তবে? তবে কতক্ষণ আর পড়ে পড়ে কাঁদতে দেওয়া যায় মল্লিকাকে?
.
প্রভাত মনে মনে সংকল্প মন্ত্রপাঠ করে, নাঃ, কাল থেকে আর এ রকম নয়। মল্লিকার দিকে একটু অধিক দৃষ্টি দিতে হবে। মল্লিকার জন্যে একটু অধিক সময়।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই
পাড়ার যে পুরনো ক্লাবটা একদা প্রভাতের কৈশোর আর নব-যৌবন কালের একান্ত আনন্দের আশ্রয় ছিল, যার মাধ্যমেই তারা গড়ে তুলেছিল ওই হাওড়া যুব পাঠাগার, আর এখন যে ক্লাবের টিম বড় বড় জায়গায় খেলতে যায়, তারই বর্তমান কর্মকর্তারা ধরে করে পড়েছে প্রভাতকে স্থায়ী প্রেসিডেন্ট হতে হবে।
ছেঁকে ধরেছে তারা, প্রভাতদা, আগের যাঁরা, তাঁরা কেউই প্রায় এদিকে নজর দেন না, কেউ কেউ বা অন্য জায়গায় চলে গেছেন, আমরা যা পারছি করছি। আপনি যখন আমাদের ভাগ্যে এসে পড়েছেন, আর ছাড়ছি না আপনাকে।
ছাড়ছি না ছাড়ব না।
আজন্মের পরিচিত ঠাই যেন এই কটা উৎসুক ছেলের মধ্যে দিয়েই স্নেহ-কঠিন দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায়, ছাড়ছি না! ছাড়ব না।
মা বলেন, আর ছাড়ব না।
মন বলে, আর ছাড়ব না।
আর অনেক যোজন দূরের আকাশ থেকে যে পাখীটিকে ধরে এনে খাঁচায় পুরেছে প্রভাত? সেও বুঝি পরম নির্ভরে বুকের কাছে আশ্রয় নিয়ে মৌন সজল দৃষ্টির মধ্যে বলে ছাড়ব না, ছাড়ছি না।
এমন একান্ত করে প্রভাতের হয়ে যেতে না পারলে, মামাকে দেখে কি একটুও উতলা হত না মল্লিকা? বলত না একবারটি নয় ঘুরে আসি, চিরকালের জায়গা
মামা তো আর ঘাতকের বেশে আসে নি, এসেছিল নিতান্তই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়ের রূপেই। কিন্তু মল্লিকা একবারও বলেনি, দেখতে ইচ্ছে করে সেই জায়গাটা।
না, মল্লিকা তা বলেনি। মল্লিকা তা বলতে পারে না।
মল্লিকা নীল আকাশের ওড়া পাখী ছিল না। ও যে পায়ে শিকলি বাঁধা খেলোয়াড়ের খেলা দেখানো পাখী ছিল। প্রভাত তাকে আপনার খাঁচায় এনে রেখেছে বটে, কিন্তু পায়ের শিকলি তো কেটে দিয়েছে।
তাই না সে অমন নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে শুধু দুটি চোখের চাহনি দিয়েই আশ্বাস দেয় প্রভাতকে, ছাড়ব না ছাড়ব না।
মল্লিকা সুখী। মল্লিকাকে সুখী করতে পেরেছে প্রভাত। মল্লিকা কৃতজ্ঞ। মল্লিকাকে কৃতজ্ঞ হবার অবকাশ দিয়েছে প্রভাত। মাঝে মাঝে একটু উল্টোপাল্টা আচরণ করে বটে, সেটা নিতান্তই ওর অভিমানী স্বভাবের ফল। তাই তো ভাবতে হচ্ছে প্রভাতকে, ছুটির দিনগুলো আর কাজের দিনের সন্ধ্যাগুলো মল্লিকার জন্যে রাখতে হবে।
ওই ক্লাবের ছেলেগুলোর কাছ থেকে কি করে ছাড়ান পাওয়া যাবে?
আর আপাতত মল্লিকার এই অভিমানের কান্নার হাত থেকে?
অনেক চেষ্টায় আর অনেক যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয় প্রভাতকে, মল্লিকা কি ভেবেছে বিরক্ত হয়েছে প্রভাত? পাগল নাকি! মল্লিকার ওপর বিরক্তির প্রশ্ন ওঠেই না। কিন্তু এখানকার জ্ঞাতি সমাজ তত ভাল নয়? ওই পরিমলটার যদি পরীক্ষার ফল ভাল না হয়, সবাই দূষতে বসবে মল্লিকাকেই। বলবে–আড্ডা দিয়ে দিয়ে ছেলেটার মাথা খেয়েছে মল্লিকা। ওটা যে এই তিনবার ঘষটে ঘষটে ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে, সে কথা কেউ মনে রাখবে না।
তবে নিজেরা সাবধান হওয়াই ভাল।
ওকে ভয় পাওয়াবার জন্যেই বিরক্তির ভান দেখাতে হয়েছে প্রভাতকে। এইসব যুক্তির জাল বোনে প্রভাত। মল্লিকার কাছে বসে। একসময় মল্লিকা চুপ করে।
আর তারপর সহসা উঠে একেবারে নীচের তলায় নেমে গিয়ে করুণাময়ীর কাছে বসে।
প্রভাত আত্মপ্রসাদে পুলকিত হয়, নিজের বুদ্ধি আর যুক্তির কার্যকারিতায়।
.
কিন্তু মল্লিকার ওই আকস্মিক কান্না কি সত্যিই প্রভাতের বিরক্তি প্রকাশের অভিমানে? না, সে কান্না গভীরতর কোন অবচেতনার স্তর থেকে উঠছে এক অক্ষমতার নিরুপায়তায়?
.
-বউয়ের আওতা ছাড়িয়ে ছেলেকে একেবারে একা পাওয়া বড়ই শক্ত। ধারে কাছে বৌ নেই, ছেলের কাছে বসে দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইলাম, কি হল বৌয়ের একটু সমালোচনা, তার আচার-আচরণের একটু নিন্দেবাদ, এমন মাহেন্দ্রক্ষণ জোটা দুষ্কর দিদি।
এ যুগের বৌগুলোই হচ্ছে শাস্ত্রসম্মত সাধ্বী-সতী। স্বামীর একেবারে ছায়ায় ছায়ায় ঘোরে। ফাঁক পাওয়ার আশা দুরাশা।…আগের আমলে শুধু শোওয়াটাই একসঙ্গে ছিল, তাও যতটা সম্ভব সন্তর্পণে। আর এখনকার আমলে দিদি, খাওয়া শোওয়া ওঠা বসা চলাফেরা, বেড়ানো না বেড়ানো, সব যুগলে।..আদেখলে ছোঁড়ারা কেন যে আপিস যাবার সময়টুকুও বৌকে বগলদাবা করে নিয়ে যায় না তাই ভাবি। সেটুকু ফাঁক রাখে বোধহয় বউদের দিবে-নিদ্রের জন্যে। নইলে–শুনলে বিশ্বাস করবে, আমার ছেলে চুল ছাঁটতে গেল, বৌ সঙ্গে সঙ্গে চলল সেলুনে। কেলাব লাইব্রেরী সিনেমা থিয়েটার, আত্মজনের বাড়ী, সর্বত্র চলল কাছা ধরে।…কোথাও একলা ছাড়বে না। ছেলে তো মা বলে ডেকে কাছে এসে বসতে ভুলেই গেছে!
এক নাগাড়ে এই শতখানেক শব্দযুক্ত আক্ষেপোক্তিটি করে নিশ্বাস নিলে করুণাময়ীর পাঠবাড়ীর বান্ধবী।
করুণাময়ী কিন্তু এ বিবৃতিতে সই দেন না। বরং বলেন, আমার ছেলে বৌ কিন্তু অমন নয় ভাই।
ছেলে বৌ বলতে অবশ্য করুণাময়ী তার ছোট ছেলে বৌয়ের কথাই মনে নিলেন। কিন্তু বান্ধবীটি কথায় হেরে–ছোট হয়ে যাবার পাত্রী নয়। তিনি সবেগে বলেন, রেখে দাও দিদি তোমার ছেলে বৌয়ের গুণগরিমা। বড় মেজ তো বুকের ওপর পাঁচিল তুলে বসে বসে গুণ দেখাচ্ছেন, আর এটিও কম নয়। তুমি দোষ ঢাকলে কি হবে, পাড়াপড়শী তত আর কানা নয়? ওইতো সবাই বলছিল, কাল তোমার ছেলেবৌ নাকি ওদের কেলাবের লাইব্রেরিতে গিয়েছিল, আর তোমার বৌ নাকি রাজ্যির ছেলেগুলোর সঙ্গে বাঁচালতা করছিল। তা সাধ্যি আছে তোমার সেকথা তুলে বকতে, না সময় মিলছে ছেলেকে আড়ালে ডেকে অত আস্কারা দিতে মানা করতে? হুঁ, কিন্তু যাই বল ভাই, পাড়ার বৌঝিরা কেউ আর এখন বৌটি নেই বটে, তবে কেলাবে লাইব্রেরিতে কেউ যায় নি অদ্যাবধি।