বলি এত সব জানল কোথায় ও?
কী জানি বাবা! আমরা তো সাতজন্মেও শুনি নি ওসব, জানা তো দূরের কথা। শুধু কি তাই, ঠাকুরপোর কাছে নাকি একদিন বাহাদুরী করে বলেছে-যত রকম মদ আছে জগতে, আর যতরকম সিগারেট পাওয়া যায় বাজারে, ও নাকি সমস্তর নাম জানে।
এত সব তোমায় বলল কে গো?
কে আর, ছোঁড়াটাই। বলেছে কি আর বুঝে? আমিই কুরে কুরে বার করেছি। এতক্ষণ কিসের কথা হচ্ছিল গো? জিগ্যেস করলেই ভয় পেয়ে বলে ফেলে, কিছু কথা হচ্ছিল না, শুধু মুখপানে চেয়ে বসেছিলাম এই কথা পাছে দাঁড়ায়, সেই ভয় আর কি।
তা ভয় ভাঙতে আর কতক্ষণ? মেয়েমানুষ যদি প্রশ্রয় দেয়! হাঁদা ছেলেটার পরকাল ঝরঝরে হল আর কি!
আমাদের ছোটবাবুরও হয়েছে ভাল! ওই বৌয়ের মনোরঞ্জন করে তো চলতে হচ্ছে?
.
এমনি অনেক কথা হয় দুই জায়ে।
এমনিতে যারা পান থেকে চুন খসলে পাড়া জানিয়ে কেঁদল করে।
ওদের আলোচনার মধ্যে থেকে যে ইশারা উঁকি মারে, সেটা কিন্তু খুব একটা মিথ্যে নয়। খুড়তুতো দ্যাওর পরিমলকে নিয়ে হঠাৎ যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে মল্লিকা। বিশেষ করে তাস নিয়ে যেন মেতে ওঠে, কাড়াকাড়ি হুড়োহুড়ি আর সহসা উচ্চকিত হাসির শব্দ বাড়ি ছাড়িয়ে অন্য বাড়ি পৌঁছায়।
করুণাময়ী বাড়িতে খুব কমই থাকেন এই রক্ষে, তবু মাঝে মাঝে বিরক্ত হন তিনি। বলেন, মামা এসে একদিন দেখা দিয়ে গিয়ে আসপর্দাটা যেন বড় বাড়িয়ে দিয়ে গেল মনে হচ্ছে। কই, এত বাঁচাল তো ছিল না ছোট বৌমা! এতবড় ডাগর ছেলেটার সঙ্গে এত কিসের ফষ্টি-নষ্টি? ওর লেখাপড়া আছে, ওর মাথায় তাসের নেশা ঢুকিয়ে দেবার দরকারই বা কি?
প্রভাতকে লক্ষ্য করেই অবশ্য বলতেন এসব কথা।
.
প্রথম প্রথম প্রভাত হেসে ওড়াত। বলত, ডাগর ছেলেটা তোমার বৌয়ের থেকে পাঁচ বছরের ছোট মা?…বলতো-মামা হঠাৎ একদিন দেখা দিয়ে মন কেমন বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন, মনটা প্রফুল্ল করতে যদি একটু খেলাধূলো করে ক্ষতি কি? বৌদিরা তো ও রসে বঞ্চিত, তাই পরিটাকেই ধরে এনে
বলাবাহুল্য বৌদিদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি যে করুণাময়ীর চক্ষুশূল সে কথা জানতে বাকী নেই প্রভাতের, ওইটাই বলত মাকে থামাতে। কুটিল কুচুকুরে (করুণাময়ীর ভাষায়) বউ দুটোর চেয়ে যে খোলামেলা-মন দ্যাওরপোটাকে তিনি শ্রেয় মনে করবেন এ সত্য প্রভাতের জানা।
কিন্তু প্রভাতের নিজেরই একদিন বিরক্তি এল।
ছাতে উঠে গিয়ে তাসের আসর বসানোর সখটা তার চোখে একটু বেশি বাড়াবাড়ি ঠেকল।
উঠে গেল নিজেই।
দেখল পাতা মাদুরের ওপর তাসগুলো এলোমেলো ছড়ানো, আর কি একটা জিনিস নিয়ে তুমুল কাড়াকাড়ি করছে পরিমল আর মল্লিকা।
ব্যাপার কি?
ভুরু কোঁচকালো প্রভাত।
পরিমল অপ্রতিভ হয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে বলে, দেখ না, চার টাকা হেরে গিয়ে বৌদি এখন আমার জিতের পয়সা দেবে না বলছে।
টাকা, পয়সা, এসব কি কথা? বাজী ধরে তাস খেলা হচ্ছে নাকি? ক্রুদ্ধ গম্ভীর স্বরে বলে প্রভাত। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতের সেই গাম্ভীর্যকে নস্যাৎ করে হেসে ওঠে মল্লিকা। বাঁচাল হাসি।
বাজী না ধরলে কি আর খেলায় চার্ম আসে?
না না, এসব আমার ভাল লাগে না। টাকা পয়সা নিয়ে খেলা
ভয় নেই–তোমার পয়সা খোওয়া যায় না। খেলা শেষে আবার ফেরৎ নেওয়া-নিয়ি হয়।
প্রভাত স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, তাই যদি হয় তো এ খেলার দরকারটাই বা কি?
আর সে বিরক্তিকে ব্যঙ্গ করে হেসে ওঠে মল্লিকা, দরকার যে কি, তুমি তার কি বুঝবে? ও রসে বঞ্চিত! তোমাদের এই স্রেফ আলুভাতের আস্বাদবাহী সংসারে দম বন্ধ হয়ে আসে যে মানুষের!
প্রভাত একটু নরম হয়।
ভাবে, সত্যি ও ছেলেমানুষ, একটু আমোদ আহ্লাদের দরকার আছে বইকি। বাড়িটা আমাদের সত্যিই বড় স্তিমিত। আমি সারাদিন খেটেখুটে এসে বাড়ির আরামটি, ঘরের খোটি চাই, মা নিজে পাড়া বেড়িয়ে বেড়ান, অথচ ওকে একটু আধটু বেরোতে দিতেও নারাজ, বেচারার দম বন্ধ হয়ে আসা অন্যায় নয়।
আর আর তাছাড়া
চকিত লজ্জায় একবার ভাবে, একটা বাচ্চাটাচ্চাও হলে হতে পারত এতদিনে। আর তাহলে নিঃসঙ্গতা বোধ করে পাড়ার দ্যাওরকে খোমোদ করে তাস খেলতে হত না ওকে।
কিন্তু প্রভাত বিচক্ষণ। এক্ষুণি সংসার বাড়িয়ে ফেলতে নারাজ।
সে যাক।
আপাতত ভিতরে নরম হলেও পরিমলকে শিক্ষা শাসন দেবার জন্যেই গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে, তা হোক। তাস খেলা ছাড়াও জগতে অনেক কাজ আছে। বই পড়লেই পারে। তাছাড়া দুজনে আবার খেলা কি? জমে নাকি?
হঠাৎ প্রভাতকে স্তব্ধ করে দিয়ে এক টুকরো ইঙ্গিতবাহী রহস্যময় হাসি হেসে মল্লিকা বলে ওঠে, খেলা তো দুজনেই জমে ভাল।
প্রভাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পরিমল পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়, আর মল্লিকা সহসা সেই তাস ছড়ানো পাতা মাদুরটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।
মল্লিকার হাসিটাও যেমন অস্বস্তির, কান্নাটাও তেমনি যন্ত্রণাদায়ক। আর প্রভাতের কাছে দুটোই অর্থহীন।
তবু কান্না কান্নাই। অর্থহীন হলেও কান্না দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ভয়ঙ্কর কোনও আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেলেও না। আর অপর পক্ষের কান্নার ভার এ পক্ষের অপরাধের পাল্লাটা ভারী করে তোলেই।
প্রভাতের মনে পড়ে, এর আগে আর কোনদিন মল্লিকাকে এমন তিরস্কার করে নি সে।