বেশিক্ষণ অবশ্য সন্দেহদোলায় দুলতে হল না। টাঙ্গাটা ঝড়াং করে থেমে গেল। এবং ভদ্রলোক নেমে পড়ে বললেন, এই যে এসে গেছি। সাবধানে নামুন প্রভাতবাবু।
প্রভাতবাবু!
নাম জানাজানিটা কখন হল? প্রভাত সবিস্ময়ে বলে, আমার নামটা জানলেন কি করে?
কি করে! একটু হেসে বললেন, হাত দেখে। সুটকেসের ওপর টিকিট এঁটে রেখে নিজেই ভুলে যাচ্ছেন মশাই? আসুন, এই গরীবের গরীবখানা। এই সামনের ছোট্টখানি নিয়ে সুরু করেছিলাম। আপনাদের পাঁচজনের কল্যাণে আশেপাশে–আস্তে আস্তে সাবধানে। পাথরটার ওপর পা দিয়ে আসুন। সারারাত বৃষ্টি পড়ে কাদা-মল্লিকা, তুই গণেশকে পাঠিয়ে দিগে যা। জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে নিক। প্রভাতবাবু সাবধান, শুধু এই পাতা পাথরের ওপর দিয়ে
.
সাবধানে পা টিপে টিপে এসে প্রথম কটেজটার সামনে দাঁড়ায় প্রভাত, আর সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ে।
আরাম কুঞ্জ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মডারেট চার্জে আহার ও বাসস্থান। প্রোঃ এন কে চ্যাটার্জি।
কী বোঝা উচিত ছিল, এতক্ষণে বুঝতে পারে প্রভাত। জলের মত পরিষ্কার।
লোকালয়ের বাইরে বহুবিস্তৃত জমি নিয়ে চ্যাটার্জির আরাম কুঞ্জ। ঘরের পিছনে বারান্দা। সরু একফালি, তবু তাতেই দুখানি বেতের চেয়ার, একটি ছোট টেবিল।
চায়ের ট্রে-টা চাকরেই দিয়ে যায়, তবে তত্ত্বাবধানে আসে মল্লিকাই। হেসে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে বলে, এতক্ষণে বুঝেছেন বোধ হয়?
নতুন বাড়ি, ছবির মত সাজানো ঘর, পিছনের এই বারান্দা থেকে যতদূর চোখে পড়ে, উন্মুক্ত প্রান্তর। প্রান্তরের সীমায় আকাশের কোলে পাহাড়ের নীলরেখা। মেঘমেদুর আকাশের বিষণ্ণতা কেটে আলোর আভাস উঁকি দিচ্ছে। সৌন্দর্য-মোহগ্রস্ত প্রভাত এতক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সেইদিকে, চা এবং মল্লিকা, দুটোর চাঞ্চল্যে চোখ ফিরিয়ে হেসে বলে, একটু একটু।
আপনি একটু বেশি সরল।
তার চাইতে বলুন না কেন, একটু বেশি নির্বোধ!
বলাটা ভদ্রতা নয়, এই যা।
কিন্তু কি করে জানব বলুন? ভাবলাম প্রবাসে বাঙালী মল্লিকা হেসে ওঠে।
প্রভাত ভাবে, ঠোঁটে রঙের প্রলেপ বলেই কি দাঁতগুলো অত সাদা দেখাচ্ছে? কিন্তু তাতে সাদাই দেখাবে, অমন মুক্তোর মত নিখুঁত গঠনভঙ্গী হবে?
জায়গাটা বড় সুন্দর।
হ্যাঁ। মল্লিকা ঈষৎ হাসির সঙ্গে বলে, নামটা যখন আরাম কুঞ্জ! কিন্তু হাসির সঙ্গে মুখটা এমন কঠিন হয়ে ওঠে কেন ওর?
বাস্তবিক সার্থকনামা। কিন্তু আমাকে তো এখুনি বেরুতে হবে। আমার অফিসটা কতদূরে, উত্তরে কি দক্ষিণে, পূর্বে কি পশ্চিমে কিছুই জানি না। এখানের ব্যবস্থাটাই বা কি রকম হবে–মানে আপনার বাবাকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না!
পাবেনও না। মল্লিকা হেসে ওঠে, ওই একবার যা স্টেশনে দর্শনের সৌভাগ্য। আবার গেছেন লোক ধরতে–কিন্তু উনি আমার বাবা নন, মামা।
প্রভাত যেন একটু বিমূঢ় হয়ে পড়ে।
ভদ্রলোক তাহলে স্রেফ হোটেলের আড়কাঠি! আর এই সুসজ্জিতা সুবেশা রূপসী তরুণী তার মেয়ে না হলেও ভাগ্নী!
তবে আসল মালিক বোধ হয় এর বাবা! শালাকে লাগিয়ে রেখেছেন তোক ধরে আনতে! কিন্তু সারাক্ষণ লোক কোথায়? ট্রেন তো আর বারবার আসে না!
সেই সন্দেহই ব্যক্ত করে প্রভাত।
মল্লিকা বলে, ওসব অনেক সিক্রেট! বুঝবেন না।
তা না হয় বুঝলাম না, কিন্তু এখানে থাকার ব্যবস্থা কি, চার্জ কি রকম, এখান থেকে অফিস যাওয়া সম্ভব কিনা, এগুলো তো বুঝতে হবে?
আমার কাছে সবই জানতে পারেন।
আপনিই কর্ণধার?
মল্লিকা হঠাৎ চোখ তুলে কেমন যেন একরকম করে তাকাল। তারপর বলল, দেখাশোনা করি। চা-টা খান। এখুনি তত বেরুবেন বলছেন, ভাত–
না না, ওসব কিছু না। এই এতবড় ব্রেকফাস্ট করে আবার ভাত! চার্জটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না!
মল্লিকা হেসে ওঠে।
আচ্ছা ভীতু লোক তো আপনি! মারাত্মক কিছু একটা নয়! চলুন দেখাই গে খাতাপত্তর।
চার্জ? না, এমন কিছু মারাত্মক সত্যিই নয়। ব্যবস্থার তুলনায় তো নয়ই।
ব্যবস্থা যে এত উত্তম হতে পারে, এটা প্রভাতের ধারণার মধ্যে ছিল না। আরাম কুঞ্জের শুধু যে নিজস্ব একটা টাঙ্গা আছে তাই নয়, একখানা জীপও আছে। এবং সেই জীপখানা বোর্ডারদের জন্যে সর্বদা খাটে, নিয়ে যায় শহরের মধ্যস্থলে, অফিসপাড়ায়, কর্মকেন্দ্রে।
নইলে আপনারা গরীবের আস্তানায় থাকবেন কেন? এ আপনার গিয়ে খোলা বাতাসটাও পেলেন, আবার কাজকর্মেরও অসুবিধে হল না–
প্রোঃ এন কে চ্যাটার্জি বলেন, আপনার আশীর্বাদে যিনি একবার পায়ের ধুলো দিয়েছেন, তিনি বারে বারে পায়ের ধুলো দেন।
হ্যাঁ, চ্যাটার্জির দর্শন আর একবার মিলেছে। কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে কিনা জানবার জন্যে এসেছেন। বারে বারে প্রশ্ন করছেন।
প্রভাত হেসে বলে, অসুবিধে কি মশাই, বরং সুবিধেটাই এত বেশি হয়ে যাচ্ছে যে ভয় হচ্ছে, এরপর আর কোথাও
এরপর আর কোথাও মানে? হাঁ হাঁ করে ওঠেন চ্যাটার্জি, আবার কোথায় যাবেন? নিজের ঘরবাড়ীর মতন থাকবেন। ওইজন্যেই যার টানা লম্বা ঘরদালান না করে ছোট ছোট কটেজ করা।
প্রভাত কুণ্ঠিত হাস্যে বলে, কিন্তু এই পাণ্ডববর্জিত দেশে এত লোক আসে?
বলেন কি মশাই? হা হা করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক, দেখতে নিরীহ হলে কি হবে, জায়গাটা কতবড় বিজনেস ঘাঁটি? অবিশ্যি একদিক থেকে বলেছেন ঠিকই, বাঙালী কমই আসেন। মানে, বিজনেসের ব্যাপারে তো বুঝতেই পারছেন!