জগতের যত বিস্ময় সবই কি আজ প্রভাতের জন্যই অপেক্ষা করছিল?
শাণিত ছোরার বদলে আশীর্বাদের শান্তিবারি?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রভাত আর কিছু ভেবে না পেয়ে হঠাৎ হেঁট হয়ে চাটুয্যের পায়ের ধুলো নেয়। ঠিক যেমন নেয় ভদ্র জামাইরা বাড়িতে শ্বশুর-সম্পৰ্কীয় কেউ বেড়াতে এলে।
চাটুয্যেও ঠিক ভদ্র শ্বশুরের মতই বলে, থাক থাক। দীর্ঘজীবী হও! মল্লিকা মাকে তাই বলছিলাম, অনেক জন্মের পুণ্যে দেবতার দেখা পেয়েছিলি তাই তরে গেলি, নরক থেকে ত্রাণ পেলি। স্বর্গ থেকে তোর মা আজ তোদের শত আশীর্বাদ করছে। তোমাকে আর কি বলব বাবা, পাণ্ডব-বর্জিত দেশে পড়েছিলাম, সৎপাত্রে মেয়েটার বিয়ে হয়তো জীবনেও দিতে পারতাম না। দেখে মে,-বড় শান্তি পেয়ে গেলাম। তবে যাই মা মল্লিকা। আসি বাবা প্রভাত।…বেয়ান কোথায় গেলেন, বেয়ান। বড় মহৎ মানুষ। একটু পায়ের ধুলো নিয়ে যাই।
স্বভাব-বাচাল লোকটা বেশি কথা না কয়ে পারে না। কিন্তু যারা শোনে, তারা অকূল সমুদ্রে আথালিপাথালি করতে থাকে।
সৎ বস্তু, সুন্দর বস্তু, মহৎ বস্তুকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে না পারার মত যন্ত্রণা আর কি আছে?
.
অনেক রাত্রে বোধহয় কৃষ্ণপক্ষ, আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে, জানলার ধারে চৌকীটাকে টেনে এনে বসে আছে ওরা।…প্রভাতের মুখে প্রসন্নতা। কিন্তু মল্লিকার মুখ ভাবশূন্য।
মল্লিকা যেন এখানে বসে নেই।
প্রভাত এই ছায়াছায়া জ্যোৎস্নায় হয়তো ধরতে পারে না সেই অনুপস্থিতি, তাই ওর একটা হাত হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে গভীর সুরে বলে, মানুষের কত পরিবর্তনই হয়! :
মল্লিকা কথা বলে না।
প্রভাতই আবার বলে, স্বার্থবুদ্ধিতে যাই করে থাকুন, তোমার মামা কিন্তু তোমাকে . ভালবাসেন খুব!
মল্লিকা তবু নীরব।
প্রভাত একটু অপেক্ষা করে বলে, ছেলেমেয়ে তো নেই নিজের! সাপের বাঘেরও বাৎসল্য স্নেহ থাকে। কি বল? তাই না?
মল্লিকা একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ঘুম পাচ্ছে, শুচ্ছি।
চাঁদের আলো রেলগাড়ির মধ্যেও এসে পড়েছিল। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল না নন্দকুমার চাটুয্যের। আর অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। সে ইচ্ছে কামরার দরজাটা খুলে ঝপ করে লাফিয়ে পড়বার। পড়লে কেমন হয়?
গাড়িটা যে ক্রমশই তাকে তার ভয়ঙ্কর একটা আশার ঘর থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই করতেই কি হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিল চাটুয্যে, হাজার লোকের কাছে সন্ধান নিয়ে নিয়ে? পেয়ে হারাবার জন্যে?
আশ্চর্য! বুদ্ধির গোড়ায় কি শনি ধরেছিল চাটুয্যের? তাই তার তখন অকারণ মনে হয়েছিল যার জন্যে ছুটোছুটি তার বদলে খুব মস্ত একটা কি পেলাম! সেই পরম পাওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে মুঠোয় পাওয়া জিনিস মুঠো খুলে ফেলে দিয়ে এল।
এন কে-র মত ঘোড়েল লোকটা কিনা ঘায়েল হয়ে গেল সস্তা একটু ভাবালুতায়? আসলে সর্বনাশ করেছিল মেয়েটার ওই টানটান করে চুল বাঁধা কপালের মাঝখানের মস্ত সিঁদুর টিপটা। ওই কপালটা দেখে মনে হচ্ছিল না ও মল্লিকা। মনে হল ও হরিকুমার চাটুয্যের সেই কিশোরী মেয়েটা! অকাল কুম্মাণ্ড নন্দকুমারের ছোট বোন। যে বোনটা পরে অনেক দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা সয়ে আর চেহারা সাজ বদলে তবে মরেছিল।
কিন্তু যখন মরে নি, সাজ বদলায় নি, তখন অমনি টানটান করে চুল বাঁধতো সেই মেয়েটা, আর ফর্সা ধবধপে কপালের মাঝখানে ওই রকম জ্বলজ্বলে একটা টিপ পরত।
মল্লিকা যেন নন্দকুমারের দুর্বলতার সুযোগ নেবার জন্যেই তার মরা ছোট বোনের চেহারা আর সাজ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
কিন্তু এন কে পাগল নয়। সাময়িক দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে সে।
উঃ, যাই ভাগ্যিস ঠিকানাটা ভাল করে লিখে আনা হয়েছে।
গণেশ মুচকি হেসে বলে, জানতাম!
জানতিস? কী জানতিস রে তুই শূয়ার?
জানতাম ফিরিয়ে আনতে পারবেন না
পারব না? অমনি জানতিস তুই?
চিরপরিচিত পরিবেশে ফিরে এসে নিজেকে একটা গাধা বলে মনে হয় চাটুয্যের। তবু মুখে হারে না। বলে, তোর মতন তো বুন্ধু নই যে একটা হঠকারিতা করে বসব? দেখে এলাম, এবার চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে। ট্যান্ডন ফিরেছে?
কবে! এসে বলল, এন কে-র মেয়েকে খুঁজে বেড়াবার এত কী দায় আমার? মেয়ের কি অভাব আছে? ভাড়া ফেললেই মেলে। কত চাও?
হু। টাকার কাঁড়ি খেয়ে আবার লম্বা লম্বা বোলচাল। দেখাচ্ছি বাছাধনকে। আর নায়ার?
তার কোন খবর জানি না।
.
তা খবর জানবার কথাও নয়। সে তখন চাটুয্যের ফেলে আসা পথেই ঘোরাফেরা করছে।
সে কথা বলাবলি করে করুণাময়ীর বড়বৌ আর মেজবৌ। পরনিন্দারূপ মহৎ আর শোভন কাজটিতে তাদের ভাবের আর অন্ত নেই।
সেই ভাবের ক্ষেত্রে বসে দুজনে বলাবলি করে, মামা এসে যাবার পর থেকে ছোট বৌয়ের কী রকম অহঙ্কার অহঙ্কার ভাব হয়েছে দেখেছিস?
তা আর দেখিনি? শাশুড়িকে লুকিয়ে কত আসত, বসত, কাজ শিখত আগ্রহ করে, আর এখন এমুখো হয় না।
দেখেছি তাই! এখন আবার দেখছি ওবাড়ির নতুন ঠাকুরপোর সঙ্গে ভাবের ঢলাঢলি, না কি জুয়া খেলাখেলি চলে।
জুয়া।
তাই তো বলল ঠাকুরপো। ডাকলাম সেদিন যাবার পথে। বললাম, কী গো, নতুনকে পেয়ে পুরনোদের যে একেবারে ভুলেই গেলে? তা অপ্রতিভ হয়ে বলল, প্রভাতদার বৌ অনেক রকম তাসখেলা জানে, তাই শিখছি
লজ্জাও করে না। মেয়েমানুষের কাছে খেলা শেখা
মরণ তোমার! মেয়েমানুষই তো সকল খেলার কাজী। তেমন তেমন খেলিয়ে মেয়েমানুষ হলে–তা আমাদের ইটিও তো কম যান না। এসে অবধি তো অনেক খেলাই দেখাচ্ছেন। এই একেবারে কনে বউটি, চোখ তুলে তাকান না। এই আবার দেখ, যেন সিনেমা অ্যাকট্রেস। চোখের চাউনি ভুরুর নাচুনি দেখলে তাক লেগে যায়। ঠাট দেখলে গা জ্বলে। ঠাকুরপো চুপি চুপি বলল, ওসব তাস খেলা নাকি স্রেফ জুয়া খেলা। বাজী ধরে খেলা তো? বলে নাকি কত খারাপ খারাপ বড়লোক ওই তাস খেলাতেই সর্বস্বান্ত হয়।