নইলে চাটুয্যের ব্যবসা পড়ে যাবে? আয় উন্নতি কমে যাবে?
মাতালগুলোকে আরও মাতাল করে ফেলে যে সুবিধেগুলো আদায় করতে পারত সেগুলো আর আদায় হবে না?
অতএব চাটুয্যে—
কিন্তু জীবনে একবার যদি চাটুয্যে তার সেই পাষণ্ড নামের ঐতিহ্য ভোলে? যদি সত্যিকার মামা কাকার মত মেয়েটাকে আশীর্বাদ করে তাকে তার কল্যাণের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত রেখে হাসিমুখে ফিরে যায়?
লোকসান হবে এন কে-র।
কিন্ত কতখানি?
কত খাবে সে একটা পেটে? কত পরবে একটা দেহে? কতদিন আরও বাঁচবে– বাহান্ন বছর পার হয়ে যাবার পর?
.
চিন্তাজর্জর প্রভাত বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই করুণাময়ী কাছে এসে ব্যঙ্গমিশ্রিত খুশী খুশী হাসি হেসে বলেন, ওরে প্রভাত, তোর বউয়ের যে কপাল ফিরেছে, নিরুদ্দিশ রাজার উদ্দিশ হয়েছে। মামা এসেছে দেখতে!
কে এসেছে? কে?
বজ্রাহতের মত আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রভাত। অনেকরকম ভাবছিল সে, কিন্তু এই প্রকাশ্য অভিযানের চেহারা একবারও কল্পনা করে নি।
তা হাঁ হয়ে যাবারই কথা। ছোট বৌমাও শুনে প্রথমটা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল, হাঁ করে তাকিয়ে বসেছিল। মামাকে নাকি আবার ভয়ও করে খুব। মানুষটা কিন্তু ভয়ের মত নয়। বরং একটু হ্যাঁবলা-ক্যাবলা মতন। আর বিনয়ের তো অবতার। বেয়ান বেয়ান করে একেবারে জোড়হস্ত।
প্রভাত সাবধানে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, কতক্ষণ এসেছেন?
এই তো খানিক আগে। ফল মিষ্টি সরবৎ খাইয়েছি। দৈ-দস্তুর করলাম, তা বলছে থাকতে পারবে না, রাত্তিরের গাড়িতেই চলে যেতে হবে। কী যেন দরকারি কাজে একদিনের জন্যে এসেছে, নেহাৎ নাকি জামাইবাড়িটা হাওড়া ইস্টিশনের গায়ে, তাই করুণাময়ী মুখে চোখে একটি আত্মপ্রসাদের ভঙ্গী এঁকে কথার উপসংহার করেন, তবু আমি একেবারে ছেড়ে কথা কইনি, শুনিয়ে দিয়েছি বুড়োকে বেশ দুচার কথা–
প্রভাত রুদ্ধকণ্ঠে বলে, শুনিয়ে দিয়েছ? কী শুনিয়ে দিয়েছ?
কী আবার শোনাব, ন্যায্য কথাই শুনিয়েছি। কেন, তোর পরমপূজ্য মামাশ্বশুরের বুঝি আর দোষত্রুটি কিছু নেই? বলি সাতজন্মে একটা উদ্দিশ করে? আজ এখন একদিন এক হাঁড়ি রসগোল্লা এনে
রসগোল্লা? এক হাঁড়ি রসগোল্লা! প্রভাত হঠাৎ চাপা গর্জনে বলে ওঠে, তোমার ছোট বউ খেয়েছে সে রসগোল্লা?
ওমা শোন কথা! আসতে আসতেই অমনি হাঁড়ি খুলে খাওয়াতে বসব? কেন, আমার বউ কি পেট ধুয়ে বসেছিল? বলি মামাশ্বশুরের নাম শুনে তুই অমন ভূতে পাওয়ার মতন করছিস কেন? তোরও কি ভয়ের ছোঁয়া লাগল নাকি? তা ছোট বৌমা তো তবু যাই হোক ধাতস্থ হয়ে
কোথায় সে? তার সঙ্গে এক ঘরে?
মার বিস্ময় অগ্রাহ্য করে প্রভাত মরীয়ার মত ছোটে। কী এনেছে মল্লিকার মামা মল্লিকার জন্যে?
বিষমাখানো রসগোল্লা, না বিষাক্ত ছুরি?
করুণাময়ী গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবেন। ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত করেন, আর কিছু নয়, বুড়োটার অমতেই বোধহয় এ কাজ হয়েছে। তাই দুটোতেই ভয় পাচ্ছে। তখনই বুঝেছিলাম গণ্ডগোল একটা আছেই। তবু যতই হোক স্নেহ নিম্নগামী। তাই বুড়ো একঘণ্টার জন্যেও মরতে মরতে দেখতে এসেছে মিষ্টির হাঁড়ি বুকে করে। যাই হাঁড়িটা সরিয়ে ফেলি। বেশি করে চারটি ভাল দিকে রাখতে হবে। পাঠক ঠাকুরের জন্যে নিয়ে যাব। কিনে কেটে বেশি দেওয়া তো হয় না বড়।…যে আমার বড় বউটি আর মেজ বউটি, এক্ষনি উঁকি দেবে, আর ছোটজায়ের কান ভাঙাবে, তোর মামা অত মিষ্টি আনল, তুই কটা পেলি?
৪. রসগোল্লা সামলাতে
রসগোল্লা সামলাতে সরে যান করুণাময়ী।
কিন্তু করুণাময়ীর ছেলে কেমন করে সামলাবে নি জকে? কী করে বুঝবে এ স্বপ্ন না মায়া? শয়তানী না স্বর্গীয় সুষমা?
আরাম কুঞ্জর প্রোপ্রাইটার এন, কে চ্যাটার্জি কি হঠাৎ ঈশ্বরের স্পর্শ পেয়ে সমস্ত ক্লেদমুক্ত। হয়ে, মহৎ হয়ে গেছে? সুন্দর হয়ে উঠেছে?
.
হয়তো তাই।
হয়তো ক্লেদাক্ত মানুষটা নির্মল হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের স্পর্শ কখনো কখনো এসে পৌঁছায় বুঝি কুৎসিত জীবনের কাদার উপর।
তাই বারংবার কোটের হাতায় চোখ মুছছে রিষড়ের হরিকুমারের ছেলে নন্দকুমার।
সুখে থাক মা, শান্তিতে থাক। আমি তোর হতভাগা পাষণ্ড মামা, কত জুলুম করেছি তোর ওপর, কত কষ্ট দিয়েছি। তবু এটুকু মনে জানিস যা করেছি বুদ্ধির ভুলে করেছি। কিন্তু তুই আমার মেয়ে নয় ভাগ্নী, একথা কোনদিন মনে করি নি।
মল্লিকা বুঝতে পারে না।
মল্লিকা দিশেহারা হয়ে এই ভাবাবেগের অর্থ খোঁজে। এ কী তার চির অভিনেতা মামার এক নতুন অভিনয়? নিখুঁত, নিপুণ! নাকি হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আর অসম্ভবকে সম্ভব করা সন্ধান করে করে শুধু তার পালানো ভাগ্নীকে আশীর্বাদ করতে এসেছে আরাম কুঞ্জর প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি?
সেই আশীর্বাদটুকু দিয়েই আবার ফিরে চলে যাবে সেই হাজার মাইল ভেঙে? কোনও উদ্দেশ্যসিদ্ধি নয়? কোনও হিংস্র প্রতিশোধ নয়? অতীত কলঙ্কের কথা ফাঁস করে দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা নয়, কিছুই নয়?
এই যে বাবাজী।
তাড়াতাড়ি চোখের শেষ আর্দ্রতাটুকু কোটের হাতায় নিশ্চিহ্ন করে চাটুয্যে বলে, কী বলে যে তোমায় আশীর্বাদ করব! ভাল ভাল কথা তেমন জানি না, তাই শুধু বলছি তুমি সুখী হও, দেবতা তুমি, অধিক আর কি বলব।
প্রভাত থতমত খায়। হতভম্ব হয়। এ কী!