না না, বিপদ কিছু হয়নি।
আচ্ছা বাড়ি গিয়ে কি তবে মল্লিকাকে এই খবরটা জানিয়ে সাবধান করে রাখবে প্রভাত? বলবে, কে জানে হয়তো তোমার মামা এতদিনে সন্ধান পেয়ে–
না, না, কাজ নেই।
প্রভাত ভাবল, অকারণ ভয় পাইয়ে দিয়ে লাভ কি? হয়তো সত্যিই কিছু না।
অজস্র ভাবনা এসে ভিড় করে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে আসে।
মানুষ নির্ভীক হয় কেমন করে? সামান্যতম ভয়ের ছায়াতেই যদি তার দেহমন অবশ হয়ে আসে?
ভেবে পায় না প্রভাত, কি করে মানুষ ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব কাণ্ডের নায়ক হয়ে হাস্যমুখে ঘুরে বেড়াতে পারে সমাজের সর্বস্তরে?
আবার ভাবল, আশ্চর্য! আমিই বা কি করে পেরেছিলাম মল্লিকাকে চুরি করে আনতে?
প্রভাত যখন ভাবনার সমুদ্রে এমনি টলমল করতে করতে বাড়ি ফিরছিল, তখন প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি প্রভাতেরই এক জ্ঞাতি কাকার বাড়িতে জাঁকিয়ে বসে প্রশ্ন করছিল, বলেন কি? আপনারা তাকে জাতিচ্যুত করলেন না?
জাতিচ্যুত!
জ্ঞাতিকাকা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, জাতি কোথায় যে তার থেকে চ্যুত করব? আপনি ঘটকালি করে খান, আপনি খবর রাখেন না একালে জাতি ধর্ম কথাগুলো কোন পাঁশগাদায় আশ্রয় পেয়েছে?
জানি আজ্ঞে। জানি সবই। তবে কিনা আপনারা হলেন গিয়ে গোস্বামী বংশোদ্ভূত, আপনাদের কথা অবিশ্যিই স্বতন্ত্র।
কিছু স্বতন্ত্র নয়, দাদা! ও আপনার গিয়ে সবাইকেই এক জাঁতার তলায় ফেলে পেষাই করা হচ্ছে। হ্যাঁ, ছিল বটে মানমর্যাদা এক সময়। সে সব এখন হাস্যকর। কুলশীল বংশমর্যাদা ওসব কথাগুলোই এখন ভূতো হয়ে গেছে, ওকথা বলতে গেলে লোকে এখন হাসে, নাক বাঁকায়। নইলে–এই তো, কোথা থেকে না কোথা থেকে একটা পরমা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এল, বলল কোন চুলোয় কাকা না মামা কে আছে, ব্যস, হয়ে গেল সে মেয়ে ঘরের বৌ। সে বৌ ভাতের হাঁড়িতেও কাঠি দিচ্ছে, নারায়ণের ঘরেও সন্ধ্যেদীপ দিচ্ছে। পাড়াপড়শীর বাড়ি গিয়ে এক পংক্তিতে খাচ্ছেও। আমরাই আর ওসব মীন করি না। যে কালে যে ধর্ম।…তবে হ্যাঁ, মেয়েটি বড় লক্ষ্মী। যেমন দেবী প্রতিমার মত রূপ, শুনেছি তেমনি নাকি শিক্ষা সহবৎ।…যাক মশাই, তাই হলেই হল। এ যুগের কাছে আমরা এই আগের যুগেরা কতটুকু কী চাই বলুন তো? ওই একটু শিক্ষা সহবৎ। গুরুজনকে ক্ষ্যামাঘেন্না করে একটু গুরুজন বলে মানল তো বর্তে গেলাম আমরা। তা আমার বড়ভাজের কাছে, মানে ওই প্রভাতবাবুর মায়ের কাছে শুনতে পাই মেয়ের নাকি গুণের সীমা নেই।…এই–এইটুকুই তো দরকার। যাক আপনাকে আর বেশি কি বলব? দেখতেই পাচ্ছেন। আপনারও কর্মভোগ, তাই এসেছেন বিয়ে হওয়া ছেলের জন্যে সম্বন্ধ করতে! হাতের কাছে আর কোনও পাত্র তো দেখছিও না যে আপনাকে–
থাক থাক।
চ্যাটার্জি উঠে পড়ে বলে, এইটির কথাই শুনে এসেছিলাম। তবে কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেছে। যাক, আপনার মত একজন সজ্জন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হল, এটাই পরম লাভ।
বিনয়ে বিগলিত হয় সে।
জ্ঞাতিকাকা বলেন, সজ্জন? হাসালেন মশাই। দুর্জন, অতি দুর্জন। তবে নাকি দুনিয়ার হালচাল দেখে দার্শনিক হয়ে গেছি। নইলে ওই কাণ্ডর পর আমার ওই জ্ঞাতি ভাজের বাড়ীতে কাউকে জলস্পর্শ করতে দিতাম? দিতাম না, আগে হলে দিতাম না। এখন ওই যা বললাম–দার্শনিক হয়ে গেছি। তবে হ্যাঁ, মেয়েটা খারাপ ঘরের নয়, দেখলেই বোঝা যায়। এই যে আমি কে না কে, কিন্তু নিত্য সকালে আমার ও-বাড়ীতে চায়ের বরাদ্দ হয়ে গেছে। কেন? ওই বউটির আকিঞ্চনে। কই আরও ঢের বউ তো আছে পল্লীতে, কে পুঁচছে? আমার ওই ভাজটির হাত দিয়ে তো জল গলত না, এখন বউটির কারণেই–হাঁ হয়ে যাচ্ছেন না? চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা যেতেই পারেন। এ যুগে তো আর বউ-ঝির মধ্যে এমন নম্রতা দেখা যায় না।…আচ্ছা তবে।
চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন জ্ঞাতিকাকা! তা হয়তো বোঝবার মতই বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জির চোখজোড়া।
এন কে! এই নামেই পরিচিত চ্যাটার্জি। ব্যবসাক্ষেত্রে ওটাই অনেক সময় কোডের কাজ করে। কিন্তু একদা ওর একটা নাম ছিল না? যে নাম সে নিজেই ভুলে গেছে। নন্দকুমার না? নন্দকুমার চট্টোপাধ্যায়? হরিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অকালকুষ্মণ্ড কুলাঙ্গার ছেলে?
কিন্তু তার মনটা আবার এমন নরম প্যাঁচপেচে হয়ে যাচ্ছে কী করে? খামোকা চোখেই বা তার খানিকটা জল উপচে পড়ছে কেন তার বেইমান ভাগ্নীটার সুখের সংসারের গল্প শুনে? আশ্চয্যি, আশ্চয্যি! এন, কে-র ভাগ্নী, যে ছিল এন, কে-র শিকার ধরবার রঙিন রেশমি কাঁদ, সে কিনা তার মার মত বোনের মত ঠাকুমা পিসিমাদের মত লক্ষ্মী বউ নাম কিনে সুখে শান্তিতে স্বামীর ঘর করছে!
সে আর নরককুণ্ডে বসে লুব্ধ শয়তানদের হাতে মদের গ্লাস এগিয়ে দেয় না, স্বর্গের এক কোণায় ঠাঁই করে নিয়েছে সে নিজের, সেখানে বসে সে ঠাকুরের নৈবেদ্য সাজায়, গুরুজন পরিজনদের হাতে তৃষ্ণার জল এগিয়ে দেয়।
চাটুয্যে কি তার চিরদিনের পাষণ্ড নামের ঐতিহ্য বহন করেই চলবে? স্বর্গের এক কোণে যে এতটুকু একটু জায়গা গড়ে নিয়ে শুভ্র হয়ে উঠেছে, পবিত্র হয়ে উঠেছে, তাকে তার সেই জায়গা থেকে টেনে নামাবে? চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে আবার সেই পুরনো নরককুণ্ডে? তাকে ডাণ্ডা মেরে মেরে বাধ্য করবে ক্ষুধার্ত বাঘেদের গুহায় ঢুকতে? বাধ্য করবে সেই বাঘেদের মদের গ্লাস এগিয়ে দিতে, তাদের সামনে ঘুঙুর পরে নাচতে, কটাক্ষ হেনে মন কাড়তে?