মল্লিকানামা দেহটা যেন একটা মসৃণ কোমল আবরণ। আর শঙ্কা হয়–যে কোনও মুহূর্তে সে আবরণ ভেদ করে ঝলসে উঠবে ভিতরের প্রখরা।
কিন্তু এ ধারণাটা অন্যায়, এ চিন্তাটা হাস্যকর। প্রভাত ভাবে ওই তো কপালে মস্ত একটা সিঁদুরের টিপ, বাম হাতে গোটা তিন চার লোহা, দুহাতে শাঁখা চুড়ি বালা। নেহাৎ ঘরোয়া।
শাড়ী পরার ধরনটা পর্যন্ত ঘরোয়া করে ফেলেছে। একেবারে ঘরোয়া। মল্লিকা বদলে গেছে। মল্লিকা ঘরোয়া হয়ে গেছে।
প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
হ্যাঁ, স্বস্তি হয়েছে আজকাল সবদিকেই।
মল্লিকাকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর থেকে সর্বদা যে ভয়ঙ্কর একটা অশরীরী আতঙ্ক প্রভাতের পিছু নিয়ে ফিরত, সে আতঙ্কটা ক্রমশই যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশই ভাবতে অভ্যস্থ হচ্ছে, নাঃ, সে যেমন ভেবেছিলাম তেমন নয়।
একেবারে ডিটেকটিভ গল্পের নর-পিশাচ নয়। প্রথমটায় হয়তো খুব রেগেছিল, শাপ শাপান্ত করেছিল। হয়তো দুটোকে খুন করে ফেলবার স্পৃহাও জেগেছিল মনে, কিন্তু শেষে নিশ্চয়ই ভেবেছে এই নিয়ে টানাটানি করতে গেলে নিজেদেরই কোন ফাঁকে পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হবে। আর সাধের ব্যবসা এবং প্রাণটি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
অতএব মনের রাগ মনে চেপে বসে আছে ভদ্রলোক।
শাপশাপান্ত? এ যুগে ওতে আর কিছুই হয় না।
কলিযুগে ব্রহ্মতেজ নির্বাসিত, ব্রহ্মশাপ নিষ্ফল। কাজেই স্বস্তি! স্বস্তি! স্বস্তি!
কিন্তু স্বস্তি বোধকরি প্রভাতের কপালে নেই। তাই ক্রমেই যখন তার জীবনটায় ছায়ার চেয়ে আলোর ভাগটাই বেশি হয়ে এসেছে, তখন হঠাৎ আবার ভয়ঙ্কর এক অস্বস্তির কাটা এসে বিধল বুকের মধ্যে।
অফিসে টিফিন করতে বেরিয়েছিল, ফিরে আসতেই সহকর্মী সুরেশ দত্ত খবরটা দিল।
প্রভাত বিচলিত চিত্তে প্রশ্ন করল, আমার সন্ধান নিচ্ছিল? নানান প্রশ্ন করছিল? কেন বলুন তো? কি রকম দেখতে লোকটা?
সুরেশ দত্ত আরামে পা নাচাতে নাচাতে বলে, অনেকটা ঘটক-প্যাটার্নের দেখতে, বুঝলেন? প্রজাপতি অফিস থেকে এরকম চরটর পাঠায় অফিসে টফিসে। আইবুড়ো শুনল, কি গাঁথবার তালে লেগে পড়ল।
প্রভাত বিরক্ত সুরে বলে, তা আমি তো আর আইবুড়ো নই? আমার সন্ধানসুলুক নেবার দরকারটা কি?
ওই তো–সুরেশ দত্ত একটি রহস্যময় মধুর হাসি হেসে বলে, দিলাম একখানি রাম ভাঁওতা। এখন খুঁজুক বসে বসে আপনার ঠিকুজিবুলুজি গাঁইগোত্তর! তারপর
থামুন আপনি। ছেলেমানুষী করবেন না
সুরেশ দত্তর আরও গড়িয়ে পড়া মোলায়েম মসৃণ হাসিখানিকে নিভিয়ে দিয়ে প্রভাত প্রায় ধমকে ওঠে, ঠাট্টাতামাসারও একটা মাত্রা রাখা উচিত।
সুরেশ বোধ করি অপমান ঢাকতেই অপমানটা হজম করে নিয়ে বিলম্বিত দীর্ঘ লয়ে বলে, মাত্রা আছে বলেই তো আপনাকে এগিয়ে ধরলাম। না থাকলে নিজেকেই একখানি সুপাত্র বলে চালান করতাম। করলাম না। ভেবে দেখলাম–বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে যদি সেখানে ধাওয়া করে, কে জানে লোকটা পৈতৃক প্রাণটুকু খুইয়ে আসবে কিনা। মানে আমার গিন্নীটির কবলে পড়লে
বাজে কথা রাখুন মশাই, লোকটার চেহারা কিরকম তাই বলুন?
সুরেশ দত্ত সোজা হয়ে উঠে বসে বলে, ব্যাপারটা কী বলুন তো প্রভাতবাবু? আপনার ধরণধারণ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি যেন ফেরারি আসামী আর টিকটিকি পুলিশ আপনার সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। লোকটা তো অফিসের অনেকেরই নামধাম খোঁজ করছিল, কে কে ব্যাচিলার আছে সেইদিকেই যেন ঝোঁক তার। তা কই আর তো কেউ আপনার মত ক্ষেপে উঠল না? বললাম তো শচীনকে অমরকে শ্যামলবাবুকে।
এবার প্রভাত একটু লজ্জিত হয়।
তাড়াতাড়ি বলে, ক্ষ্যাপার কথা হচ্ছে না। আপনি খামোকা লোকটাকে আমার একটা ভুল পরিচয় দিতে গেলেন কেন, তাই ভাবছি। হয়তো ওই ব্যাচিলার শুনে বাড়ি গিয়ে ঝামেলা করবে।
করুক না। একটু মজা হবে।
সুরেশ আবার আরামের এলায়িত ভঙ্গী করে বলে, জীবনটাকে একেবারে মিলিটারীর দৃষ্টিতে দেখবেন কেন? একটু রঙ্গরস, একটু মজা, একটু ভুল-বোঝাবুঝি–এসব নইলে আর রইল কি মশাই?
নাঃ আপনি একেবারে– বলে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে চলে যায় প্রভাত। কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারে না। মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে।
কে সে?
কে আসতে পারে প্রভাতের খোঁজে?
আরাম কুঞ্জের প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি ছাড়া প্রভাতের জানাশোনাদের মধ্যে কে এমন আধবয়সী ভদ্রলোক আছে, যে তোক গলাবন্ধ কোট পরে?
আচ্ছা, প্রভাত এতই বা ভাবছে কেন?
সত্যিই তো ওই প্রজাপতি অফিসের লোক হতে পারে? নিছক বাজে একটা লোককে নিয়ে মিথ্যে মাথা ঘামাচ্ছে প্রভাত?
ভাবে।
মনকে প্রবোধ দেয়।
কিন্তু মন প্রবোধ মানে না। সে যেন একটা অশরীরী ছায়া দেখতে পাচ্ছে, যে ছায়া তার অন্ধকারের মুঠি বাড়িয়ে প্রভাতের গলা টিপে ধরতে আসছে।
.
অফিস ফেরার পথে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে চলে প্রভাত।
ইতিমধ্যেই কি বাড়ীতে কোনও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে গেছে? প্রভাতকে ফিরে গিয়েই সেই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে?
কী সেই দৃশ্য? মল্লিকা নেই? মল্লিকা খুন হয়েছে?
ভগবান! এ কী আবোলতাবোল ভাবছে প্রভাত? বাড়ীতে তেমন কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে প্রভাতকে কেউ খবর দিত না? পাড়ায় তো জ্ঞাতিগোত্রের অভাব নেই। এমনিতে তারা সর্বদা বুকের মধ্যে দীর্ঘঈ পুষে রাখলেও, বিপদেআপদে দেখে বইকি।