কিন্তু মল্লিকার ছিল সৌন্দর্যানুভূতি, আর এখানে এসে সৃষ্টি হল একটি মন। গ্রামে ঘরে যে সব সুন্দর বস্তু অবহেলিত, মল্লিকার তৃষিত চোখে তা অভিনব, অপূর্ব। তাই ওর ফুলদানীতে ফুলের গা ঘিরে ঠাই পায় সজনেপাতা, তেঁতুলপাতা। চালকুমড়োকে মাথায় তুলে এতাবৎ যে বাঁশের মাচাটা হাড়-বার-করা দেহখানা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উঠোনের কোণে, মল্লিকা তার হাড় ঢেকে দেয় মালতি লতা দিয়ে। মাচাটা হয়ে ওঠে কুঞ্জবন। গোবরলেপা উঠোনের মাঝখানে আলপনা আঁকে পদ্মলতা শঙ্খলতায়। সন্ধ্যায় সেখানে মাটির পিলসুজে প্রদীপ রাখে। জীবনের মোড় ঘোরাতে চাইলে বুঝি এমনি করেই সাধনা করতে ইচ্ছে হয়।
তা সাধনায় বোধ করি সিদ্ধিলাভ করতে পৈরেছে মল্লিকা। মাঝখানে কিছুদিন যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল সে চাঞ্চল্যকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলে সত্যিই সে তার মায়ের মত শাশুড়ির মত। পিতামহীদের মত হচ্ছে।
বিরল তোমার ভবনখানি পুস্পকানন মাঝে,
হে কল্যাণী ব্যস্ত আছ নিত্য গৃহকাজে।
বাইরে তোমার আম্রশাখে
স্নিগ্ধ রবে কোকিল ডাকে,
ঘরে শিশুর কলধ্বনি
য্যাঃ অসভ্য! মল্লিকা চকিত কটাক্ষে হেসে ফেলে। হেসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে শাশুড়ি বাড়িতে আছেন কিনা। না নেই, বাড়িতে তিনি কমই থাকেন। পাড়া বেড়ানো, গঙ্গাস্নান, পাঠবাড়ী ইত্যাদি নানা কর্মের স্রোতে বেড়ান তিনি। আসল কথা দুই ছেলে বৌ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর প্রভাতও যখন বিদেশে চলে গেল, শূন্যঘর আর শূন্যহৃদয় করুণাময়ী হৃদয়ের আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগলেন বাইরের হিজিবিজির মধ্যে।
এখন ঘরের শূন্যতা ঘুচেছে, হৃদয়ের শূন্যতা ঘুচেছে, কিন্তু অভ্যাসটা ঘুচছে না। তাছাড়া এখন আবার গৃহকর্মের অনেক ভার মল্লিকা নিয়েছে। তাই তিনি মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ান। তবে মল্লিকার ওপর চোখ রাখবার চোখ যে একেবারে নেই তা নয়। মল্লিকার বড় মেজ দুই জা, যাঁরা একই বাড়িতে ভিন্ন হয়ে আছেন, তারা এই উড়ে এসে জুড়ে বসা ছোট জায়ের গতিবিধির প্রতি সাধ্যমত দৃষ্টি রাখেন, আর এ বিষয়ে দুজনেই অভিন্ন আত্মা। কিন্তু মজা এই, তাদের দুজোড়া চোখ অদৃশ্য পথে দৃষ্টি ফেলে বসে থাকে, মল্লিকার সেটা জানা নেই। তাই মল্লিকা প্রভাতের ছেলেমানুষীতে অথরা কাব্যি ওখলানোয় বিব্রত পুলকে এদিক ওদিক তাকায় শুধু শাশুড়ি বাড়িতে আছেন কিনা দেখতে।
নেই দেখে সহাস্যে বলে, কেরানীগিরি করে করেও এত কাব্য টিকে আছে প্রাণে?
থাকবে না মানে? প্রভাত হাসে, কাব্য কি শুধুই বড়লোকের জন্যে? কেরানীরা অপাংক্তেয়?
শুনেছি তো ও কাজ করতে করতে লোকের মাথার ঘি-টি সব ঘুঁটে হয়ে যায়।
যায় বুঝি? কই আমার তো তা মনে
এই, কী হচ্ছে? ছাড়!
যদি না ছাড়ি।
রাহুর প্রেম?
প্রায় তাই। কোথায় ছিলে, কোথা থেকে শিকড় উপড়ে নিয়ে এসে পুঁতে দিলাম বাংলাদেশের ভিজে ভিজে নরম মাটিতে
সে মাটির মর্যাদা কি রাখতে পেরেছি?
নম্র নম্র বিষণ্ণ দুটি চোখ তুলে প্রশ্ন করে মল্লিকা, চাপল্য ত্যাগ করে।
প্রভাতও চপলতা ছেড়ে গম্ভীর হয়।
বলে, পেরেছ বই কি।
মল্লিকা চুপ করে থাকে।
আবহাওয়া কেমন থমথমে হয়ে যায়।
এক সময় মল্লিকা বলে ওঠে, মা বলছিলেন, তোমার মামা কেমনধারা লোক গো বৌমা! একখানা পোস্টকার্ড লিখেও তো কই উদ্দিশ করে না?
তুমি কি উত্তর দিলে?
কি আর দেব? বললাম, মামা এই রকমই। দায় চুকেছে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। নইলে আর সম্প্রদান করার কষ্টটুকু পোহাতে রাজী হন না, কুমারী মেয়েটাকে একজনের হাতে ছেড়ে দেন। মা বললেন, তা সত্যি! ধন্যি বটে।…তা ছাড়া তুমিও তো কই চিঠিপত্র লেখ না?…আবার কথা। বানাতে হল, বলতে হল, মামাকে চিঠি লিখি এত সাহস আমার নেই। ভীষণ ভয় করতাম তাকে। যা কিছু আদর আবদার ছিল, মামীর কাছে।
অনেক গল্প বানাতে শেখা গেল, কি বল? কলম ধরলে সাহিত্যিক নাম লাভ হতে পারত! হেসে বলে প্রভাত, একেবারে কথার জাল বোনা।
মল্লিকা বিমনা ভাবে বলে, তবু ফাঁক থেকে যায় কত জায়গায়। প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে।
মামা খোঁজ করছেন বলে মনে হয় তোমার?
পাগল হয়েছ? প্রভাত হাসে, মেয়ে পালালে কেউ খোঁজ নেয়?
ঠিক এই স্কেলে তো আমার জীবন আর সে জীবনের পরিস্থিতিকে মাপা চলে না? কে জানে তিনি বসে বসে প্রতিশোধের ছুরি শানাচ্ছেন কিনা!
ছুরি শানাচ্ছেন, এ ভয় প্রভাতেরই কি নেই? তবু সে পুরুষমানুষ, মুখে হারতে রাজী নয়, তাই বলে ওঠে, ছুরি অত সস্তা নয়।
বলে, কিন্তু বুকের মধ্যে ছুরি তার ঊচোনই আছে। তবে এইটুকুই শুধু ভরসা, কলকাতার এই পঞ্চাশ লক্ষ লোকের মধ্য থেকে একটা লোককে খুঁজে বার করা সহজ নয়। বোধ করি সম্ভবই নয়।
তবু প্রায়ই এমন হয়।
আলোর ওপর হঠাৎ ছায়া এসে পড়ে। শুধু সে ছায়া স্থায়ী হতে পারে না, প্রভাতের স্বভাবের ঔজ্জ্বল্যে আর মল্লিকার একান্ত চেষ্টায়।…হঠাৎ এসে পড়া ছায়াকে প্রভাত উড়িয়ে দেয়, মল্লিকা চাপা দেয়।
কিন্তু মল্লিকাকে কি প্রভাত সম্পূর্ণ বুঝতে পারে?
এইখানেই কোথায় যেন সন্দেহের খটকা। মল্লিকার কল্যাণী বধূমূর্তির অন্তরালে কি একটা উদ্দাম যৌবনা নারী যখন তখন শান্তস্বভাব প্রভাতকে প্রখর যৌবনের জ্বালা দিয়ে পুড়িতে মারতে চায় না–প্রভাত নামক নিরীহ পুরুষটাকে?