গণেশ নিজস্ব স্টাইলে বলে, আজ্ঞে মনে করি মায়া দয়া বলে জিনিসগুলো বাক্স থেকে বার করব না। তবু কেমন এসে পড়ে। তাতেই বলছি, না উড়েই বা করবে কি? পাখীর প্রাণ বই তো নয়! হাতী পুষতে যদি কেউ পাখীর মাংসর ওপর ভরসা রাখে
কী বললি? কী বললি পাজী?
কিছু না বাবু, কিছু না।
হুঁ। বুঝেছি, তুমিই যত নষ্টের গোড়া!
.
অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে চাটুয্যে। তারপর স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে চলে যায়। অনেক দূরসমুদ্রে।
সেই তার ছোট বোনটা। মল্লিকার মা।
লক্ষ্মীপ্রতিমার মত মূর্তিটি।
মল্লিকা কি তার মত হতে চায়? আর মল্লিকা যা চায়, তাই তবে হতে দেবে চাটুয্যে!
এই আরাম কুঞ্জের পাট চুকিয়ে চাটি বাটি গুটিয়ে ফিরে যাবে সেই দূর ঘাটে? যে ঘাট থেকে একদিন নৌকোর রাশ কেটে দরিয়ায় ভেসেছিল? আর ভাসতে ভাসতে পাঞ্জাব সীমান্তের এই পাহাড়ে বরাত ঠুকে–বরাত ফিরিয়েছিল?
.
আরাম কুঞ্জর কুঞ্জ ভেঙে দিয়ে পয়সাকড়ি গুটিয়ে নিয়ে চাটুয্যে যদি জন্মভূমিতে ফিরে যায়, করে খেতে তো আর হবে না তাকে এ জীবনে?
মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে চাটুয্যের।
সত্যি হয় না আর তা?
কিন্তু কেনই বা হবে না? আর বেশি টাকার কি দরকার তার? না বৌ না ছেলে। না ভাই, না বন্ধু! একটা পুষ্যি ছিল, তা সেটাও শিকলি কেটে হাওয়া হল। কার জন্যে তবে কি? অনেক পাপ তো করা হল, বাকী জীবনটা ধর্মকর্ম করে
হঠাৎ নিজের মনেই হেসে ওঠে চাটুয্যে, ক্ষেপে গেল নাকি সে? তাই বিড়ালতপস্বী হবার বাসনা জাগল? একেই বুঝি শ্মশানবৈরাগ্য বলে?
উঠে পড়ল। পরামর্শ করতে গেল প্রিয় বান্ধব ট্যান্ডন আর নায়ারের সঙ্গে।
একত্রে নয়, আলাদা আলাদা।
বিশ্বাস সে কাউকে করে না। কে বলতে পারে ওদের মধ্যেই কেউ মল্লিকা হরণের নায়ক কি না।
চাটুয্যে শুধু সেই কবি কবি বাঙালী ছোঁড়াটাকেই সন্দেহ করছে। ও ছোঁড়াগুলোর ভালবাসাবাসির ন্যাকরাই জানা আছে, আর কোনও ক্ষমতা আছে?
এমনও তো হতে পারে, প্রভাত গোস্বামী মল্লিকাকে সরায় নি। প্রভাত গোস্বামীকেই কেউ ইহলোক থেকে সরিয়ে ফেলে মল্লিকাকে সরিয়েছে। আর সন্দেহের অবকাশ যাতে না থাকে, তার জন্যে এইখানেই নিরীহ সেজে বসে আছে।
গণশা অত লম্বা চওড়া কথা কয়। কে জানে সেটাও ছল কিনা। টাকার কাছে আবার নেমক! মোটা টাকা ঘুষ পেয়ে লোকে নিজের স্ত্রী-কন্যেকে বেচে দিচ্ছে তো এ কোন ছার!
মনিবের ঘরের মেয়ে! ভারী তো!
ট্যান্ডন নায়ার আর বাসনধোয়া দাইটা তিনজনকেই বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপরে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন। হারিয়ে গেল বলে হারিয়ে যেতে দেবে মল্লিকা নামক ঐশ্বর্যটিকে? তাই কখনো হয়?
উঁকি মারল গিয়ে ট্যান্ডনের ঘরে!
বোতল নিয়ে বসেছিল সে।
সাড়া পেয়ে মৃদু হাস্যে বলল, আইয়ে জী!
হাসুক।
বিশ্বাস কেউ কাউকে করে না। চোরাচালানের আর চোরাইমালের ব্যবসা করে করে ওদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই চোর হয়ে গেছে।
তাই এরা যাদের সঙ্গে গুপ্ত পরামর্শ করে, তাদেরই ধাপ্পা দেয়, যাদের দিয়ে গোপন কাজ করায়, তাদের ওপরই আবার চর বসায়। তাই চ্যাটার্জি যখন মেয়ে চুরির কাহিনী শুনিয়ে হাহাকার করে, ওরা তখন ভাবে, খুব ধড়িবাজ বটে বুড়োটা, নিজেই কোন কারণে সরিয়ে ফেলে, এখন তোক দেখিয়ে আক্ষেপের অভিনয় করছে।…খুব সম্ভব কোনও কাপ্তেন-মার্কা বড়লোকের খপরে চালান করেছে।
তবু খোঁজবার প্রতিশ্রুতি সকলেই দেয়। শুধু নায়ার আর ট্যান্ডনই নয়, আরও যারা ছিল খদ্দের। জেনেছে তো সকলেই। কেউ আকাশ থেকে পড়েছে, কেউ বিজ্ঞের হাসি হেসেছে। চ্যাটার্জির মতন ঘুঘু ব্যক্তির চোখ এড়িয়ে তার ভাগ্নী হাওয়া হল, এ কী আর একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা?
কিন্তু পুরো অবিশ্বাস করাও তো চলছে না, মোটা টাকা খরচা কবলাচ্ছে চ্যাটার্জী উড়ে যাওয়া পাখী ধরে আনতে!
পুলিশে খবর দেবার উপায় তো আর নেই? নিজের পায়ে নিজে কুড়ল কে মারে? তা ওরা গোয়েন্দা পুলিশের বাবা–যাদের নিয়ে কারবার চ্যাটার্জির, যারা তার আরাম কুঞ্জের চিরকালের খদ্দের।
.
সামান্য যে কালো মেঘটুকু মাঝে মাঝে ছায়া ফেলছিল সেটুকু বুঝি মুছে গেছে। মল্লিকা যেন মূর্তিমন্ত কল্যাণী। ঘরের কাজের পটুতা তার অসামান্য, তার উপর আছে শিল্পরুচি সৌন্দর্য। বোধ। সমস্ত সংসারটির উপর সেই রুচির আলপনা এঁকেছে সে।
অবশ্য প্রথম প্রথম যখন মল্লিকা সখ করে ঘরে ঝুলিয়েছিল নতুন ধানের শীষের গোছা, দালানের কোণে কোণে চৌকী পেতে চিত্র করা ঘট বসিয়ে, তার মধ্যে বসিয়েছিল কাশফুলের ঝাড়, সংসারেরই এখান ওখান থেকে তামা পিতলের ছোট ছোট ঘটি সংগ্রহ করে তাদের ফুলদানী বানিয়ে ঘরে ঘরে নিত্য রাখতে অভ্যাস করেছিল ফুলের মেলা, তখন তার জায়েরা ননদ-সম্পৰ্কীয়রা আর পড়শীনিরা মুখে আঁচল দিয়ে হেসেছিল, এবং করুণাময়ী বিরসমুখে বলেছিলেন, সময় নষ্ট করে কী ছেলেমানুষী কর ছোট বৌমা? অবসর সময়ে গেরস্থর ভোলা কাজগুলো করলেও তো হয়।
কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল যারা হেসেছিল, তাদের ঘরেই মল্লিকার অনুকরণ। তারা নিজেরা না করুক, তাদের মেয়েটেয়েরা লুফে নিচ্ছে এই সৌখিনতা।
কিন্তু এসব কি মল্লিকা তার মামার আশ্রয় থেকে শিখেছিল? যেখানে রাত্রে বিছানায় শুয়ে বাঘের গর্জন কানে আসে, সেখানে ফুল কোথা? লতা কোথা? কোথায় বা সবুজের সমারোহ? ছিল না।