ওই যে বলছিলেন মাথা ফাটাবেন–
ওরে বজ্জাত! সমানে তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি চালিয়ে যাচ্ছিস? শেষকালে কী রাগের মাথায় সত্যিই একটা খুননাখুনি করে বসব? দেখতে পাচ্ছিস না মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলছে? সেই গোস্বামীটাকে যদি এখন হাতে পেতাম–
গণেশ উদাস মুখে বলে, তেনার আর দোষ কি?
দোষ নেই? তার দোষ নেই? তবে কি ট্যান্ডনটা–
আহা-হা রাম রাম! তা কেন? ট্যান্ডন ফ্যান্ডন নায়ার ফায়ার, ওনারা সকলেই মহৎ চরিত্তিরের লোক! পরস্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকান না, তা ফুসলে বার করে নিয়ে যাওয়া
গণশা! কার কাছে টাকা খেয়েছিস তুই, তাই বল আমায়।
টাকা! ছিঃ বাবু, ছি ছি। ওই ছোট কথাটা মুখ দিয়ে বার করতে আপনার লজ্জা লাগল না? গণশা যদি টাকা খেয়ে বেইমানি করার মতন ছুঁচো বেক্তি হত, আরাম কুঞ্জের একখানা ইটও গেড়ে থাকত এখানে? বলে পুলিশের টিকটিকি এসে কেতা কেতা নোট নিয়ে
গণেশ সহসা চুপ করে যায়। আত্মগরিমা করা তার নীতিবিরুদ্ধ।
চাটুয্যে নরম হন।
বিনীত গলায় বলেন, তা কি আর জানি নে রে বাপ! তোর গুণেই তো বেঁচে আছি। কিন্তু যা কাণ্ড ঘটে গেল, তাতে তো আর মাথা ফাতা ঠিক থাকে না। বল দিকি সেই গোঁসাই পাজীটাকে কি করে কুকুরে খাওয়াই?
শুধু পরের ছেলের ওপর গোঁসা করে কী হবে বাবু? ঘরের মেয়ের ব্যাভারটাও ভাবুন? নেমক যে খায়নি, তার তো আর নেমকহারামীর দোষ অর্শায় না, কিন্তু নেমক খেয়ে খেয়ে যে হাতীটি হল? দিদি বাবু যা করল—
চাটুয্যে বসে পড়ে অসহায় কণ্ঠে বলে, আচ্ছা গণেশ, বল দিকি কি করে করল? আমি তাকে সেই এতটুকু বয়েস থেকে লালোম পালোম, লেখাপড়া শেখালাম, কেতাকানুন শেখালাম, আর সে আমার মুখে জুতো মেরে
গণেশ নির্লিপ্ত স্বরে বলে, সবই করেছিলেন বাবু, শুধু একটা কাজ করতে ভুলে গেছলেন। মানুষটা করেন নি। লেলেছেন পেলেছেন সবই ঠিক, ওই মানুষটা করে তুলতে বাকী থেকে গেছে। মানুষ করলে কি আর নেমকহারামীটা
দেখ গণশা–এমন ভাবে এক কথায় হারিয়ে যেতে তাকে আমি দেব না। যে করে হোক খুঁজে তাকে আনতেই হবে।
তা তো হবেই বাবু। নইলে তো আপনার আরাম কুঞ্জর ব্যবসাটাই লাটে ওঠে।
চাটুয্যে সন্দিগ্ধভাবে বলে, গণশা তোর কথাবার্তাগুলো তো সুচাকের নয়, কেমন যেন ভ্যাঙচানি ভ্যাঙচানি সুরে কথা কইছিস মনে হচ্ছে।
কী যে বলেন বাবু।
তবে শোন। সোজা হয়ে কথার জবাব দে। কাল কখন সেই হারামজাদার ব্যাটা হারামজাদাকে শেষ দেখেছিলি?
আজ্ঞে রাতে খাওয়ার সময়।
আর মল্লিকাকে?
আজ্ঞে তার ঘণ্টা দুই পরে। রান্নাঘর মেটানোর সময়।
তারপর? কখন সেই শয়তান দুটো একত্র হয়ে কেউ টের পেল না?
আজ্ঞে নরলোকের কেউ টের পেলে তো আর তাদেরকে স্বর্গলোকে পৌঁছতে হত না।
তুই ভোরে উঠে খোঁজ করেছিলি?
গণেশ ঈষৎ মাথা চুলকে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে, আজ্ঞে সত্যি কথা বলতে হলে, খোঁজ একবার মাঝরাত্তিরেই করতে হয়েছেল।
তার মানে?
তার মানে আজ্ঞে, জানেন তো সব। পাপমুখে আর কবুল করাচ্ছেন কেন? যেই মাঝ রাত্তিরে ওই আপনার নায়ার সাহেবের হঠাৎ পিপাসা পেয়ে গেল, আমাকে ডেকে অর্ডার করলেন মিস সাহেবকে দিয়ে এক গেলাস জল পাঠিয়ে দিতে, তা আমি খোঁজ করে গিয়ে বললাম, হবে না সাহেব। পাখী বাসায় নেই। বোধ করি অন্য ডালে গিয়ে বসেছে
চাটুয্যে হঠাৎ দুহাতে গণেশের কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে বলে, শালা পাজী, তক্ষুণি আমাকে এসে খবর দিলি নে কেন?
গণেশ নির্বাক, নিষ্কম্প।
আজ্ঞে সে রেওয়াজ তো নেই।
আমার সন্দেহ হচ্ছে, এর মূলে তোর হাত আছে। তোর সাহায্য না পেলে
এ সন্দেহ তো বাবু আপনার সঙ্গের সাথী। শুধু আপনার কেন, আদিঅন্তকালের পৃথিবীতে আপনার মত তাবৎ মহাপুরুষেরই এই অভ্যেস। যার কাছে বিশ্বাস, তাকেই সব থেকে অবিশ্বাস।
আচ্ছা গণশা, এই দুঃসময়ে তুই আমার কথার দোষত্রুটি ধরছিস! বুঝছিস না আমার প্রাণের মধ্যে কী আগুন জ্বলছে! মল্লিকা আমার সঙ্গে কি করল!
আজ্ঞে এই তো দুনিয়ার নিয়ম।
আচ্ছা আমিও দেখে নেব, সেই বা কেমন চীজ আর আমিই বা কেমন চীজ। সেই গোসাঁইটাকে ধরে এনে যদি মল্লিকার সামনে টুকরো টুকরো করে না কাটতে পারি
বাবু খপ করে অত সব দিব্যি-টিব্যি গেলে বসবেন না। এই ভারতখানা তো আপনার হাতের চেটো নয়?
নয় কি হয় তা দেখাব। তবে তুই বদমাস যদি বিপক্ষে ষড়যন্ত্র না করিস
আজ্ঞে আবার বেমাত্রা হচ্ছেন বাবু। বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করতে শিখলে এর অনেক আগে মিস সাহেব পাচার হয়ে যেতে পারত। ওই আপনার গিয়ে নেমকহারামীটির ভয়ে ধর্ম-অধর্ম পাপ পুণ্যি মায়াদয়া, মানুষমনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দিয়ে বসে আছি!
গণেশ রে, আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
তা একটুক্ষণ নয় কাদুন! ভেতরের গ্যাসটা একটু খোলসা হোক।
তোর কি মনে হয় বল তো? মল্লিকাকে আর পাওয়া যাবে না?
এ দুনিয়ায় অসম্ভব সম্ভব হলে কি না হতে পারে!
চাটুয্যে মিনিট দুই গুম হয়ে থেকে বলে, হাঁ, হায়েনাটাকে একবার ঘর থেকে বার করে আন দিকি, আর–আচ্ছা, আর শোন, কাগে-বগে যেন টেরটা না পায় এখন
আজ্ঞে টের পেতে তো বাকীও নেই আর কেউ। কে না জেনেছে?
জেনেছে? আঃ! সবাই জেনে ফেলেছে?
আজ্ঞে নিয্যস!
চাটুয্যে মাথার চুল মুঠোয় চেপে বলে, যাবে, এইবার যাবে, আরাম কুঞ্জ শেষ হয়ে যাবে। আরাম কুঞ্জর প্রাণপাখীই যখন উড়ে গেল!