কেন? কেন? কেনই বা তা হবে না তুমি? হঠাৎ দুখানা সর্পিল হাত বেষ্টন করে ধরে প্রভাতকে, পিষ্ট করে ফেলতে চায় যেন, কেন তুমি এত বেশি জোলো হবে? আমার রূপটা বুঝি তুচ্ছ করার মত? এতে মুগ্ধ হওয়া অগৌরব?
উঃ উঃ, ছাড় ছাড়, লাগে লাগে। প্রভাত হেসে ফেলে। হেসে বলে, পাহাড়ে মেয়ের আদরও পাহাড়ে। স্বীকার করছি বাবা, এ হতভাগ্য ওই রূপের অনলে একেবারে দগ্ধপক্ষ পতঙ্গ, এখন তার বাকীটুকু আর চোখের অনলে ভস্ম করে ফেলো না।
মল্লিকা হাত দুখানাকে কোলের ওপর জড় করে নেয়, মল্লিকা সহসা স্থির হয়ে যায়। স্তিমিত গলায় বলে, অপমান করলেই করব হয়তো।
অপমান?
হ্যাঁ।
কিন্তু মল্লিকা কিন্তু-টিন্তু জানি না। কিসে মান কিসে অপমান সে বোধ তোমার থাকলে তো? আশ্চর্য, তুমি যে কেন এত বেশি ঠাণ্ডা! তোমার দাদারা তো
কি আমার দাদারা?
কিছু না।
বাঃ, আধখানা বলে রেখে আধকপালে ধরিয়ে দিতে চাও?
না, তা চাই না। বলছিলাম তোমার দাদাদের তো বেশ প্রাণশক্তি আছে—
রাতদিন বৌদিদের সঙ্গে ঝগড়া চলে বলে। তা যদি হয়, স্বীকার করছি আমার প্রাণশক্তির অভাব আছে।
কিন্তু ঝগড়া জিনিসটা খারাপ নয়।
খারাপ নয়!
না। ওতে ভিতরের বন্ধ বাতাস মুক্তি পায়। মনের মধ্যে তিলতিল করে যে অভিযোগ জমে ওঠে, তাকে বেরুবার পথ দেওয়া হয়।
যা দেখছি ও-বাড়ীর জেঠিমার মত পাড়াকুঁদুলি নামটি আহরণ না করে ছাড়বে না তুমি। যাক আমাকে একটু খেতে পরতে দিলেই হল। তোমার গৃহে গৃহপালিত পোষ্য হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আগের কথাটায় ফিরে আসা যাক, তুমি চিঠিতে কাকীমাকে অনুরোধ করেছ আমাকে আবার ওদিকে একটা চাকরী করে দিতে? প্রভাতের চোখে গভীরতা।
মল্লিকা সেই গভীর দৃষ্টির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে বলে, করেছিলাম।
কেন বল তো? তুমি তো তা চাওনি—
যদি বলি, তখন চাইনি, এখন চাইছি!
কিন্তু কেন? বাংলা দেশের জলহাওয়া আর ভাল লাগছে না, না সহ্য হচ্ছে না?
মল্লিকা প্রভাতের এই সহজ প্রশ্নটুকুতেই কেমন কেঁপে ওঠে। কোথায় যেন ভয়ানক একটা ব্যাকুলতা। কণ্ঠেও সেই ব্যাকুল সুর ফোটে, আমি বুঝি শুধু আমার কথাই ভেবেছি? শুধু আমার জন্যেই বলছি? আমার অহেতুক একটা তুচ্ছ ভয়ের জন্যে তোমার কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝি আমাকে কষ্ট দেয় না?
এই কথা! প্রভাত যেন অকূল সমুদ্রে কূল পায়। অন্ধকারে আলো পায়।
এই কথা! এই ভেবে তুমি মাথাখারাপ করছ? আর আমি যদি বলি কেরিয়ার নষ্টটা তোমার মনের ভ্রম! আমি যদি সন্তুষ্ট থাকতে পারি–আমি যা পেয়েছি, যাতে আছি, তাতেই সুখী যদি হই, তাহলে কে নষ্ট করতে পারে আমার ভবিষ্যৎ? ওই বাজে কথাটা ভেবে তুমি মনখারাপ কোর না মল্লিকা। নাই বা হল আমাদের জীবনকাব্যের মলাটটা খুব রংচঙে গর্জাস, ভিতরের কবিতায় থাকুক ছন্দের লালিত্য, ভাবের মাধুর্য। আর সে থাকা তো আমাদের নিজেদেরই হাতে! তাই নয় কি মল্লিকা? আমার বাবা আমার দাদারা যেভাবে জীবনটা কাটিয়ে গেলেন, কাটিয়ে আসছেন সুখ-দুঃখের ছোট্ট নৌকাখানি বেয়ে, আমরাও যদি তেমনিভাবে কাটিয়ে যাই ক্ষতি কি? তুমি পারবে না মল্লিকা আমার মা-ঠাকুমার মত জীবনে সন্তুষ্ট থাকতে?
মল্লিকা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মল্লিকার চোখে জল আসে।
মল্লিকা সেই জলভরা দুই চোখ তুলে বলে, পারব।
.
পিছিয়ে যেতে হল ফেলে আসা দিনে, ফিরে যেতে হল বাংলা থেকে পাঞ্জাবে।
গণশা হারামজাদা পাজী!
চাটুয্যে দুহাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে তেড়ে আসেন গণেশের চুল ছিঁড়তে।
তোর ষড়যন্ত্র না থাকলে এ কাজ হতেই পারে না। বল হারামজাদা শয়তান, কোথায় গেছে তারা?
গণেশ নির্বিকারের সাধক।
সে মাথা বাঁচাবার চেষ্টামাত্র না করে গম্ভীর গলায় বলে, কোথায় গেছে, সে কথা জানলে কি আর আপনাকে প্রশ্ন করতে আসতে হত বাবু? নিজে গিয়ে জানিয়ে দিয়ে আসতাম।
বিচ্ছু শয়তান! স্টুপিড গোভূত! চালাকি খেলে আমার সঙ্গে পার পাবি? বাঘা আর হায়েনা-কে যদি তোর ওপর লেলিয়ে দিই?
ইচ্ছে হয় দিন।
কবুল না করলে ওরা তোকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে, তা জানিস?
তা আর জানব না কেন বাবু? দেখলাম তো অনেক।
চুপ! নোংরা ছুঁচো ইঁদুর শূয়োের গাধার বাচ্ছা—
বাচ্ছাটাচ্ছা বলবেন না বাবু, মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না।
মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না? হারামজাদা শালা! আমার মেজাজ ঠিক রাখতে পারছি আমি, আর তুমি
ঠিক আর রাখছেন কোথায় বাবু? মেজাজ তো আকাশে চড়াচ্ছেন!
চড়াব না? তুই বলিস কিরে বদমাস? রাতারাতি সাতকৌটোর মাঝকৌটোয় ভরা রাজপুরীর প্রাণপাখীটুকু উড়ে গেল, আর আমি চুপ করে থাকব?
বাবু তো বেশ ভাল ভাল বাক্যি কইতে পারেন। সেই কবে ঠাকুমার কাছ থেকে ওই সব সোনার কাঠি সোনার কৌটোর গল্প শুনেছি
গণশা! তোকে আমি খুন করব। ন্যাকরা করছিস আমার সঙ্গে? আর সময় পেলি না ন্যাকরা করার? বল লক্ষ্মীছাড়া পাজী, দিদিমণি গেল কোথায়?
সেই পুরনো উত্তুরই দিতে হবে বাবু!
লাঠি, লাঠি চাই একটা গণশা, নিয়ে আয় শীগগির একটা লাঠি! তোর মাথাটা ফাটিয়ে তবে আজ আমি জলগ্রহণ করব–
গণেশ দ্রুত অন্তর্হিত হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে একগাছা মোটা লাঠি নিয়ে এসে মনিবের হাতে তুলে দেয়।
চাটুয্যে অবশ্য সেইটুকু সময়ের মধ্যেই ভুলে গিয়েছেন, লাঠিটা কেন চেয়েছিলেন। বলে ওঠেন, কী হবে?