আর কিছুই নয়, নিশ্চয় ওই জায়েরা তলায় তলায় ফুসলেছে। ভেন্ন হাঁড়িই করেছে ওরা, বাড়িতে আসাটি তো ছাড়ে নি। ঠাকুরপো ঠাকুরপো করে রঙ্গরসটিও কমতি নেই কিছু। ইচ্ছে হয় যে ছুঁড়িগুলোর সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যাক, এদিকে আসা বন্ধ হোক, নেহাৎ ওই নিজের পেটের ছেলে দুটোর জন্যেই মায়া। তবু তো আসে, বসে কথা কয়।
না, নতুন বৌটাকে এবার একটু কড়া নজরে রাখতে হবে। যাতে ওদের সঙ্গে বেশি মিশতে পারে। বৌটা একটু খামখেয়ালি আছে। হয়তো একদিন দেখ ভোররাত্তিরে উঠে চান করেছে, ফুল তুলেছে, চন্দন ঘষেছে, পূজোর গোছ করেছে, রান্নাঘরে গিয়ে কুটনোটি বাটনাটি করতে লেগেছে। ওমা আবার একদিন দেখ, না চাননা কিছু, সক্কাল বেলা থেকে ছাতে উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন অন্য কোন জগতের মানুষ।…কিচ্ছুনা ওই কুপরামর্শ। যাই হোক প্রভাতকে আর তিনি খুড়ো-খুড়ির কবলে পড়তে যেতে দিচ্ছেন না। তোক না এখানে মাইনে কম, ঘরের ভাত খেয়ে থেকে যতটি জমবে, বাইরে গিয়ে তার ডবল মাইনে পেলেও কি তা জমবে? ভাবলেন এই যুক্তিতেই তিনি ছেলেকে কাৎ করবেন। বৌটা তাঁর দলে এই যা ভরসা, একা বাসায় যেতে চায় না।
বুকের বল নিয়ে পাড়ার বান্ধবীদের উদ্দেশে যাত্রা করেন করুণাময়ী রান্নাঘরের দরজাটায় ছেকল টেনে দিয়ে।
.
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে আলোচনা চলছিল উল্টো।
প্রভাত ঘরে ঢুকে নীচু গলায় মল্লিকাকে যে প্রশ্ন করে, সে প্রশ্নে আহত বিস্ময়ের সুর।
তুমি আমার কাকীমাকে চিঠি দিয়েছিলে?
মল্লিকা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। পাড়াগাঁয়ের বাড়ির ছোট জানালা। যার মধ্যে দিয়ে আকাশ ধরা পড়ে না, দৃষ্টি ব্যাহত হয় ঝোঁপজঙ্গলে গাছপালায়। তবু জানালার ধারেই দাঁড়িয়ে থাকে মল্লিকা যখনই সময় পায়।
প্রভাতের প্রশ্নে ফিরে না তাকিয়েই বলে, হ্যাঁ।
আশ্চর্য তো, কই বলনি তো?
কাউকে একটা চিঠি দিলে সে কথা বলতে হয় তা জানতাম না।
এভাবে বলছ কেন? ছিঃ!
মল্লিকা নীরব।
রাগ করছ? কিন্তু ভেবে দেখ, আমার কি আশ্চর্য হবার কিছু নেই, দিল্লী যাবার ব্যাপারে আপত্তি করছিলে তুমিই বেশি, অথচ তুমি কাকীমাকে জানিয়েছ বাইরে আমার জন্যে কাজ দেখতে, এটা একটা ধাঁধা নয় কি?
হঠাৎ জানালা থেকে সরে আসে মল্লিকা। এসে দাঁড়ায় প্রভাতের একেবারে নিতান্ত কাছে। রহস্যময় একটু হাসি হেসে বলে, ধাঁধা বলে ধাঁধা! একেবারে গোলকধাঁধা।
ওই রহস্যের ঝিলিক লাগানো চোখ মুখ দেখে কে পারে মাথার ঠিক রাখতে। আর যেই পারুক অন্তত প্রভাত পারে না। তাই বিগলিত আদরে বলে, মর্তবাসী অধম জীব, গোলক তত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা কোথায়? সত্যি বল না, হঠাৎ এ খেয়াল হল কেন? কাকীমাকে তো তুমি চেনোও না, বাসার ঠিকানাই বা জানলে কি করে?
মল্লিকা মুচকে হেসে বলে, ও আর জানা কি? চিঠি চুরি করে ঠিকানা জোগাড় এসব তো আমার নিত্যকর্ম ছিল। এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘরে ঢুকেছি যে, যে লোক ঘরে জেগে বসে থেকেছে, সেও বেঁকের মাথায় বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় মল্লিকা। শুধু একটু হাসে। আর ওর সেই হাসির মধ্যে ধরা পড়ে একখানি অতীতে ঘুরে বেড়ানো মন। এখানে বসে আছে মল্লিকা, তবু যেন এখানে নেই।
.
প্রভাত ওর সেই অনুপস্থিত মনের ছায়া ফেলা মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে বলে, এসব কথা তুমি আর বোলো না মল্লিকা। শুনতে বড় কষ্ট লাগে। আমার তো এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না সেই আরাম কুঞ্জর সঙ্গে কখনো কোনও যোগ ছিল তোমার।… কী অপূর্ব লাগে যখন তুমি চেলির শাড়ি পরে লক্ষ্মীর ঘরে আলপনা দাও, তুলসীতলায় প্রদীপ দাও, মায়ের রান্নার যোগাড় করে দাও, কি মিষ্টি লাগে যখন তুমি ঘরকন্নার খুঁটিনাটি কাজে ঘুরে বেড়াও মাথায় ঘোমটা দিয়ে। এ বাড়িতে তুমি কখনো ছিলে না ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভাবতে গেলে ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হয় তুমি একদা সেই বিশ্রী কুৎসিত পরিবেশে ছিলে
মল্লিকা ওর দিকে তীক্ষ্ণ কুটিল একটা দৃষ্টি ফেলে বলে, যন্ত্রণা হয়, না ঘৃণা হয়?
ঘৃণা! না মল্লিকা, ঘৃণা হয় না।
হয় না?
নাঃ, তা যদি হত তখনই হত। তাহলে তোমাকে সেখান থেকে নিয়ে এসে আমার মার রান্নাঘরে, চিরদিনের গৃহদেবতার ঘরে এনে তুলতে পারতাম না।
মল্লিকা আর একটু তীক্ষ্ণ হয়, সে তখন নতুন নেশার মোহে
ভুল করছ মল্লিকা, নেশাও নয়, মোহও নয়, সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস সেটা
তবে বোধ করি দয়া করুণা!
নিজেকে ছোট করবার জন্যে এই চেষ্টার পাগলামী কেন তোমার মল্লিকা?
ছোট করবার চেষ্টা নয়, সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করবার চেষ্টা। আর সে সত্যকে সহ্য করবার শক্তি আমার আছে। তুমি আমাকে দেখে করুণায় বিগলিত হয়ে আমার ভার গ্রহণ করলে, এটা তোমার নিজের মনের কাছে সাফাই হতে পারে, আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি বলব, তুমি রূপ-নেশাগ্রস্ত হয়ে
মল্লিকা! আমরা এখন ভদ্রঘরের স্বামী-স্ত্রী।
ওঃ আচ্ছা! খোলাখুলি কথা কওয়া তো এ সমাজে অচল! কিন্তু না জিগ্যেস করে পারছি, আমি যদি মামার একটা হাড়কুচ্ছিত হাড়মুখ ভাগ্নী হতাম?
কী হলে কী হতে, সে উত্তর দেওয়া অর্থহীন মল্লিকা। মানুষ যে কোন পরিস্থিতিতে কোন কাজ করে, অথবা করতে পারে, আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। তবু আমাকে যদি রূপমুগ্ধ পতঙ্গ বলে অভিহিত কর, সেটা তোমার আমার প্রতি নিতান্ত অবিচার হবে।