ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে পূজোর ঘরে ঢুকে ঘর মোছে, চন্দন ঘষে রাখে, ধূপ জ্বালে, তারপর সাজি হাতে নিয়ে বাগানে যায় ফুল তুলসী তুলে আনতে।
বাগান মানে নিতান্তই অযত্নবর্ধিত খানিকটা জমি, প্রভাতের মা নিজের প্রয়োজনে দুচারটে ফুল আর তুলসীর গাছ পুঁতেছেন। সে ফুল তুলতে তুলতে মল্লিকা ভাবে, এই বাগানটাকে আমি সুন্দর করে তুলব, ফুল ধরাব, রঙ ফলাব।
আকাশে এত রং, বাতাসে এত রস, সমস্ত পরিবেশে এমন স্নিগ্ধতা এমন পবিত্রতা–এ সমস্তই বিফল হবে? আমি হেরে যাব? মল্লিকার বাবার রক্ত মাথা হেঁট করে আসর ছেড়ে চলে যাবে, জয়ী হয়ে উঠবে মামার অন্ন?
ছি ছি, কী লজ্জা কী লজ্জা! কী ভাবল কাল প্রভাত? ও কী মল্লিকাকে ঘৃণা না করে পারবে?
কিন্তু তাই কি?
কোথায় পায় তবে প্রভাত সারারাত্রিব্যাপী অমন নিশ্চিন্ত শান্তির ঘুম? মল্লিকা যে সারারাত জেগে বসে থেকেছে, জানলার শিকে মাথা ঠুকেছে, অর্ধেক রাত্রে ছাতে উঠে গিয়ে প্রেতিনীর মত দীর্ঘ ছায়া ফেলে দীর্ঘশ্বাসে মর্মরিত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তার তো কিছুই টের পায়নি প্রভাত।
শেষরাত্রির স্নিগ্ধ বাতাসে আস্তে আস্তে কেমন অদ্ভুতভাবে স্তিমিত হয়ে গেছে মল্লিকা। নতুন করে সংকল্প করেছে সে তার মায়ের মত হবে। তাই ধূপের গন্ধের মধ্যে ফুলের গন্ধের মধ্যে চন্দনের গন্ধের মধ্যে তার মাকে খুঁজে পেতে চায়।
.
করুণাময়ী হৃষ্ট হন।
ভাবেন গত সন্ধ্যার অসতর্কতা; অনুতাপে আর করুণাময়ীর বাঘা শাসনের ভয়ে বৌ ঠাণ্ডা মেরে গেছে।
হুঃ বাবা, কথাতেই আছে হলুদ জব্দ শিলে, বৌ জব্দ কীলে! তা কীল মারা-টারার যুগ আর নেই অবিশ্যি, কিন্তু জিভের ওপর তো আর আইন বসানো যায় না?
কাকার একটা চিঠি এসেছে বলল প্রভাত খামের চিঠিটা হাতে নিয়ে। করুণাময়ী মুখ তুলে বললেন, খামে চিঠি! ব্যাপার কি? হঠাৎ আবার কি বার্তা? কই পড় শুনি।
প্রভাত ইতস্তত করে বলে, ওই মানে আর কি, লিখেছেন যে আমি ওখানের চাকরীটা ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত তিনি খুবই দুঃখিত ছিলেন, তা সম্প্রতি আবার একটা ভাল পোস্ট হঠাৎ খালি হয়েছে, কাকা চেষ্টা করলেই হয়ে যেতে পারে। এখন আমি যদি ইচ্ছে করি।
করুণাময়ী ছেলের কথাটা শেষ করতে দেন না, প্রায় ধেই ধেই করে ওঠেন, বটে বটে! খুব যে আমার হিতৈষী এলেন দেখছি। ছেলেটিকে বাড়ীছাড়া না করলে আর চলছে না। ভেবে বুক ফেটে যাচ্ছে যে ছেলেটা মায়ের কোলের কাছটায় রয়েছে, ঘরের দুধটা মাছটা ফলটা তরকারিটা খাচ্ছে। আর কিছু নয়, এ ওই তোর কাকীর কুপরামর্শ। আমার ছেলেটা যাতে আমার কাছে না থাকতে পায়।…সেবার অমনি বরকে পরামর্শ দিয়ে দিয়ে একটা চাকরী দিইয়ে সেই ছুতোয় নিয়ে গেল। বোনঝির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে একেবারে নয় করে নেবার তাল ছিল, তা সে গুড়ে বালি পড়েছে। তবু আবারও এখন চেষ্টা করছে কি করে মার কাছ থেকে ছেলেটাকে আবার নিয়ে
প্রভাত ব্যাকুলভাবে বলে, আচ্ছা মা, কি বলছ যা-তা?
যা-তা মানে? মিথ্যে বলছি আমি? ও যে কত বড় জাহাবাজ মেয়ে, তার কিছু জানিস তুই? তোর বড় বৌদি মেজ বৌদিকে কুমতলব দিয়ে দিয়ে ভেন্ন করালো কে? এক-একবার পূজোর সময় কি ছুটিছাটায় এসেছে, নিজের স্বাধীন সংসারের গল্প করে করে ওদের মনমেজাজ বিগড়ে দিয়ে গেছে। তাতেও আশ মিটল না, এখন শেষ চেষ্টা তোকে যাতে–
আচ্ছা মা মিথ্যে একটা মানুষকে দোষী করছ কেন? আমি বলছি এটা সম্পূর্ণ কাকার ব্যাপার। কাকাই লিখেছেন
কী লিখছে তাই শুনি ভাল করে। পড় তো দেখি—
কিন্তু প্রভাত পড়ে না।
অর্থাৎ পড়তে পারে না। এ চিঠির মধ্যে গলদ আছে। তাই চিঠিটা হাতের মধ্যেই রেখে বলে, ওই তো বললাম, দোষনীয় কিছু নেই বাপু।
বলি পড়ে যা না তুই। দুষ্য কিছু আছে কি না, সে তুই কি বুঝবি! ধরবার বুদ্ধি তোদের আছে? না বোঝবারই চোখ তোদের আছে? পড় আমি শুনি।
করুণাময়ী দুষ্য আবিষ্কারের চেষ্টা আর একাগ্রতা নিয়ে অবহিত হয়ে বসেন।
কিন্তু বিপদ হচ্ছে প্রভাতের। এ চিঠি গড়গড় করে পড়ে গেলে করুণাময়ী রসাতল করে ছাড়বেন। এক আসামীকে ছেড়ে ধরবেন আর এক আসামীকে। তাই কখনো যা না করে তাই করে বসে, মিথ্যে কথা বলে মাকে।
এ চিঠির কোনখানেই বা পড়ে শোনাব তোমাকে? তিনভাগই তো ইংরিজি। মোটকথাটা ওই যা বললাম।
একটু ইতস্তত করে, যাই দাড়িটা কামিয়ে আসি, বলে গালে হাত বুলোতে বুলোতে সরে পড়ে সে মার কাছ থেকে।
করুণাময়ী ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, তুই আজ মিথ্যে কথা বললি আমায়, আমি তোর মুখচোখ দেখে বুঝছি না? হবেই তো, কোন না কোন হাভাতের ঘরের একটা মেয়ে এনে মাথার ওপর বসিয়েছিস, এখন স্বভাব বিগড়োবে এ আর বিচিত্র কি!
বৌকে অবশ্য তিনিও শেষ পর্যন্ত দ্বিধা ত্যাগ করে বরণ করে তুলেছিলেন, গ্রহণ করে নিয়েছেন, কিন্তু সে নিতান্তই নিরুপায় হয়ে। ছেলে যখন কাজটা প্রায় সমাধা করেই বসেছে, তখন আর আপত্তি দেখিয়ে ধাষ্টামো করে লাভ কি!
তবে একটু প্রসন্নতা ছিল এই কারণে, মেজবৌটার বড় রূপের গরব ছিল, সে গরব ভাঙবার অস্তর নিয়ে ঢুকেছিল ঘোট বৌটা। তাছাড়া নিজের ছোট জায়ের খোঁতা মুখটা ভোঁতা হল তো?
মল্লিকাকে করুণাময়ী সুচক্ষেই দেখেন। বিশেষ করে যখন মল্লিকা বরটিকে নিয়ে বাসায় যাবার কুমতলবটি না করে উল্টে বরং বাসায় না যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে প্রভাতকে কলকাতায় থাকার প্ররোচনা দিল, তখন থেকে আরও সুনজরে দেখছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কদিন থেকে কেমন বিগড়ে গেছে বৌটা!