ভদ্রলোকের কথার মাঝখানে ফাঁক পাওয়া সম্বন্ধে হতাশ হয়ে, ফাঁকটা একরকম করে নিয়েই বলে ওঠে প্রভাত, তা আপনি তো এখানকার সব জানেন শোনেন–বলুন দিকি, সুবিধেমত কোনও মেস বা হোটেল কোথায় পাওয়া যেতে
বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! আমি তবে নাহোক আপনাকে দাঁড় করিয়ে সময় নষ্ট করছি কেন? মল্লিকা, শোন! কথা শোন ভদ্রলোকের! আমার নিজের আস্তানা থাকতে আমি সন্ধান দিতে যাব কোথায় মেস আছে, কোথায় হোটেল আছে! চলুন চলুন, এই গরীবের গরীবখানায় গিয়ে উঠুন তো। তারপর বুঝবেন থাকতে পারবেন কি, না পারবেন!
প্রভাত ব্যাকুল স্বরে বলে, না না, সে কি, আপনার বাড়ীতে গিয়ে উৎপাত করব কেন, আপনি শুধু যদি
আহা-হা, উৎপাত কি! এ তো আমার ভাগ্য। আপনাদের মত অতিথি পাওয়া পরম ভাগ্য। আজ ভালো লোকের মুখ দেখে উঠেছিলাম মল্লিকা, কি বলিস? চলুন চলুন, এই যে গরীবের একখানা হাঁটুভাঙা পুষ্পরথও আছে।
অদূরে অবস্থিত একটি টাঙ্গার দিকে চোখ পড়ে প্রভাতের। ভদ্রলোক কুলিটাকে চোখের ইশারা করেন এবং মুহূর্তে সে কর্তব্য পালন করে। আর প্রভাত এক নজরে দেখে এইটুকু অবশ্য অনুভবই করে, গাড়ীর ব্যাপারে ভদ্রলোক অতিবিনয়ী নয়, গাড়ীটা হাঁটুভাঙাই বটে।
সেই গাড়ীতেই যখন ভদ্রলোক প্রভাতকে উঠিয়ে দিয়ে সকন্যা নিজে উঠে পড়েন, তখন প্রভাত সভয়ে না বলে পারে না, ভেঙে যাবে না তো?
আশপাশ সচকিত করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক। হাসির দাপটে দুলে দুলে বলেন, না মশাই, সে ভয় নেই, দেখতে যেমনই হোক ভেতরে মজবুত।
কিন্তু আপনি ওদিকে কেন? প্রভাত তারস্বরে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, আপনি এদিকে আসুন। আমিই কোচম্যানের পাশে
কিন্তু ততক্ষণে বিশ্রী একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ী চলতে সুরু করেছে।
ভদ্রলোক ওদিক থেকে বলেন, না মশাই, আমার আবার উল্টোদিকে ছুটলে মাথা ঘোরে।
অতএব পরিস্থিতিটা হল এই, টাঙ্গার পিছনের সিটে প্রভাত আর মল্লিকা। প্রতিমুহূর্তে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর পরস্পরের গায়ে ধাক্কা লাগাতে লাগাতে উল্টোমুখো ছুটতে লাগল তারাই দুজনে।
যতটা সম্ভব সঙ্কুচিত হয়েও প্রভাত সেই দুরূহ অবস্থা থেকে আত্মরক্ষায় সক্ষম হল না, আর মনে মনে বলতে বলতে গেল, মাথা ঘোরাবার ব্যবস্থাটা তাহলে আমার জন্যেই বহাল হল!
এও ভাবল, ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে আত্মীয়সমাজের বাইরে থাকেন বলেই এমন মুক্তচিত্ত!
যাই হোক, আপাতত যে প্রবাসে বাঙালী লাভ হল, এ বহুজন্মের ভাগ্য। অন্তত আজকের মত মালপত্র রেখে অফিসটা তো দর্শন করে আসা যাবে। তারপর কালই একটা কোনো ব্যবস্থা করে নিতে হবে। সরকারী অফিস যখন আছে, মেস বোর্ডিং কোথাও না কোথাও যাবেই জুটে।
আবার ভাবল, এ যুগেও তাহলে এরকম অতিথিবৎসল লোক থাকে! ভদ্রলোক যদি একা হতেন, হয়তো প্রভাত কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত হত, হয়তো ভাবত এতই বা আগ্রহ কেন? মতলব খারাপ নয় তো? কোনো গুণ্ডার আড্ডায় তুলে নিয়ে গিয়ে টাকাকড়ি কেড়ে নেবে না তো!
কিন্তু সকল সন্দেহ মূক করে দিয়েছে মল্লিকার উপস্থিতি বুঝে ফেলেছে, আর কিছুই নয়, বাঙালীহীন দেশে বাঙালী-পাগলা লোক!
কিন্তু মেয়েটা একটাও কথা কয়নি কেন? বোবা নাকি? বাপ তো বারবার ডেকে ডেকে সালিশ মানছেন। যার জন্যে নামটা জানা হয়ে গেছে। বোবাকে কি কেউ ডেকে কথা কয়?
প্রভাত একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? আচ্ছা কী কথা বলা চলে? এখানের আবহাওয়া? কতদিন এদেশে আছেন? নাকি আপনাদের বাসা আর কতদূরে?
আলাপ জমাতে গেলে ভদ্রলোক বিরক্ত হবেন? নাঃ, তা নিশ্চয়ই নয়। মেয়েকে যখন এভাবে বসতে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে সোজামুখো ছুটছেন, তখন মাথার পিছনে কান খাড়া করে রেখেছেন বলে মনে হয় না।
ত্রিভঙ্গঠামে হলেও টাঙ্গাটা ছুটছিল ভালই। দুপাশে নীচু জমি, সেখানে সবুজের সমারোহ, মাঝখানে সরু আলরাস্তা চড়াই উত্রাইয়ের বৈচিত্র্যে লোভনীয়।
ক্ষণে ক্ষণে ঝাঁকুনি। তা সেটা অস্বস্তিকর হলেও তেমন বিরক্তিকর তো ঠেকছে না কই! অনেকক্ষণ চলার পর, প্রভাত যখন অনুমান করছে লোকালয়ের বাইরে চলে এসেছে, তখন দূর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট কটেজ দেখা গেল। ওদেরই একটা নিশ্চয়ই! প্রভাত এবার মনের জোর সংগ্রহ করে ধাঁ করে বলে ফেলল, আর বেশিদূর আছে নাকি?
মল্লিকা চমকালো না। বরং মনে হল যেন একটা কোনো প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুতই হচ্ছিল। কারণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ওই তো দেখা যাচ্ছে।
কথা বাড়াবার জন্যেই বলে প্রভাত, ওদের মধ্যে কোনটা?
সবগুলোই।
সবগুলো!
হ্যাঁ। তাও তো কুলিয়ে উঠছে না, আরও বাড়ী তৈরীর কথা হচ্ছে।
বিস্ময় বোধ না করে পারে না প্রভাত।
পরিবার বড় হলে বাড়ী বড় করে তৈরী করে লোকে, আলাদা আলাদা কটেজ, এটা কি রকম! তবু বলে, খুব বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি বুঝি?
হঠাৎ মল্লিকা অনুচ্চ একটু হেসে ওঠে। ঘাড়টা একটু ফিরিয়ে সামনে-ছোটা ভদ্রলোককে একবার দেখে নেয়, তারপর বলে, এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারেন নি? কী ছেলেমানুষ আপনি?
বুঝতে পারবে! কী বুঝতে পারবে প্রভাত!
ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, কোনদিন থেকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। মল্লিকাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করছে। তাই ওই কটেজগুলোর মধ্যেই বোধগম্য কিছু আছে কিনা দেখবার জন্যে অনবরত ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে থাকে।