কখন গেছে? কোন অসতর্কতায়?
ছেলেটা বোধ করি সহসা এই বাঁচাল হাসির ঘায়ে বিমূঢ় হয়ে যায়, তাকিয়ে থাকে হাঁ করে, আর লজ্জায় লাল হয়ে যায় মল্লিকার পরবর্তী কথায়, অচিন দেশের রাজকুমারীটিকে দেখছি নঠাকুরপোর বেজায় পছন্দ! একটু আধটু প্রসাদকণিকা পেয়ে ধন্য হতে চাও তো বল! রাজকুমারী কৃপণ নয়, তার ভাঁড়ারে অনেক ঐশ্বর্য।
বাক্যবাগীশ ছেলেটা তার বাক্যস্রোত হারিয়ে ফেলে নির্বোধের মত তাকিয়ে থেকে বলে, কী বলছেন?
বলছি তোমার মাথা! যে মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু নেই। সাধে কি আর তোমাদের এই বাংলাদেশে ঘেন্না ধরে যাচ্ছে আমার? নাও সরো, সরে বোসো। এখান দিয়ে আমাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে হবে। তোমার সঙ্গে ছোঁওয়া গেলে তো জাতিপাত।
ছেলেটা ত্রস্ত হয়ে সরে বসে।
মল্লিকা একটা তীব্র কটাক্ষ হেনে দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে নেমে পড়ে রান্নাঘর থেকে বাটি আনতে।
শাশুড়ির স্পেশাল পিতলের বাটিটি। যেটি দেখতে ছোট খোলে বড়।
কিন্তু সেই বাটিটি নিয়ে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অবোধ ছেলেটা একটা বেখাপা কথা। বলে বসে। বলে, সাধে কি আর এত মোহিত হয় লোকে? সুন্দর মানুষদের সবই সুন্দর। রাগও অপূর্ব।
তাই নাকি?
মল্লিকা চোখে বিদ্যুৎ হানে।
ছেলেটা বোধ করি নেহাতই ঘায়েল হয়ে গিয়ে বলে ওঠে, তাই তো! আর শাড়িখানাও কি আপনার তেমনি অদ্ভুত! পেলেন কোথায় এই বাঘ-ডোরা শাড়ি? যখন রাগ করে এখান থেকে সরে গেলেন, ঠিক যেন মনে হল একটা বাঘ চলে গেল!
কী, কী বললে? মল্লিকা যেন ছিটকে ওঠে।
ছেলেটা আর একবার থতমত খেয়ে বলে, মানে বলছি আপনার শাড়ির ছোরাটা ঠিক বাঘের গায়ের মত
বাঘ না বাঘিনী?
আর একটা বিদ্যুৎ হানে মল্লিকা। যে বিদ্যুকটাক্ষ ছেলেটা তার এই বাইশ বছরের জীবনে কোথাও কোনদিন দেখেনি।
কোথা থেকেই বা দেখবে? নিতান্তই যে গৃহপালিত জীব এরা।
তাই এবার সে ভয় পায়। ভয়ঙ্কর এক ভয়ের রোমাঞ্চ তাকে যেমন একদিক থেকে এই দাওয়ার সঙ্গে পেরেক পুঁতে আটকে রাখতে চায়, তেমনি আর একদিক থেকে ধাক্কা মেরে তাড়াতে চায়।
শেষ অবধি জয় হয় শেষোক্তেরই।
বনকচু আর আশশ্যাওড়ার জোলো জোলো বন্য গন্ধ এদের রোমাঞ্চকে ভয় করতেই শিখিয়েছে।
অতএব আমি যাই বলে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা।
মল্লিকা ওর ওই ত্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এবার একটু করুণার হাসি হাসে।
ওর মনের দৃষ্টির সামনে ভেসে আসে অনেকগুলো পুরুষের নির্লজ্জ বুভুক্ষু দৃষ্টি। যে দৃষ্টি যাই বলে সরে যেতে জানে না, খাই বলে লাফিয়ে পড়তে আসে।
যাও, বাড়ী গিয়ে মাথায় একটু ঠাণ্ডা জল দাও গে। নইলে রাতে ঘুম হবে না। বলে আর একবার তেমনি বাঁচাল হাসি হেসে ওঠে মল্লিকা।
আর ও চলে যেতেই সহসা যেন একটা নিষ্ঠুর কাঠিন্যে প্রস্তরময়ী হয়ে যায়।
কী বিশ্রী, কী পানসে এখানের এই পুরুষগুলো! ছিঃ! বাইশ বছরের একটা জোয়ান ছেলের রক্ত এত ঠাণ্ডা!
বাঘিনী দেখে ভয় পায়, তাকে শিকার করবার লোভে দুরন্ত হয়ে ওঠে না! হবেই তো, এরা যে গোস্বামী!
প্রভাত গোস্বামীর শিরায়-শিরায়ও এই জোলো রক্তের স্তিমিত প্রবাহ।
৩. খিড়কির দরজা
আর একবার খিড়কির দরজাটায় মৃদু শব্দ হয়।
প্রভাত এসে দাঁড়ায় একহাতে একটা ভাল পাকা পেঁপে, আর একহাতে একটা টাটকা ইলিশ মাছ নিয়ে।
পেঁপেটা সাবধানে দাওয়ার ধারে নামিয়ে রেখে বলে ওঠে, হুড়কোটা ভোলা পড়ে কেন? এই ভরসন্ধ্যাবেলা একা রয়েছ?
মল্লিকা মুচকি হেসে বলে, একা বলেই তো সাহস দুর্বার। মনের মানুষ ধরতে দোর খুলে রেখেছি। তা এমনি আমার কপাল যে, মনের মানুষ ধরা দিতে এসে ভয় পেয়ে পালায়।
প্রভাত অবশ্য এই উগ্র পরিহাসটুকু নিজের সম্পর্কে প্রযোজ্য করে নিয়ে পরিপাক করে ফেলতে পারে। আর পারে বলেই হেসে বলতে পারে, পালাবার আর জো কোথায়? সে তো লটকেই পড়ে আছে।…কিন্তু আজও এখনও অঙ্গে সেই বিশুদ্ধ পবিত্র শাড়ি? এত দেরি করে এলাম তবু কাজ শেষ হয়নি?
হঠাৎ মল্লিকা একটা বেপরোয়া কাজ করে বসে। শাশুড়ির চুঁমার্গের আর বিশুদ্ধতার প্রশ্ন ভুলে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে প্রভাতের গায়ের উপর প্রায় সত্যি বাঘিনীর মত। সাপের মত দুখানা হাতে তাকে পিষে ফেলে নেশা ধরানো গলায় বলে, নাই বা হল কাজ শেষ! তুমি পারো না আমাকে শেষ করে দিতে?…।
ছি ছি, এ কী! শিউরে উঠে মল্লিকাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রভাত নিজে ছিটকে পাঁচ হাত সরে গিয়ে ভৎর্সনার সুরে বলে, মার রান্না করতে করতে মাছের ওপর এসে পড়লে? দেখো তো কী অন্যায়! যাও যাও, শাড়ীটা বদলে এসো।
কিন্তু মল্লিকা স্বামীর এই ব্যস্ত অনুজ্ঞা পালনের দিক দিয়েও যায় না। বরং আর একবার কাছে। সরে এসে তাকে দুই হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে তীব্র কণ্ঠে বলে, তুমি কী, তুমি কী? তোমার দেহে কি পুরুষের রক্ত বয় না? যে রক্তে কোন কিছুতে এতটুকু সাড়া জাগে না!
বিমূঢ় প্রভাত কি বলত কে জানে, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বাইরে প্রভাত-জননীর তীব্র তিক্ত শানানো গলা বেজে ওঠে, বৌমা কি দুধ চড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছ, না পাড়া বেড়াতে গেছ! দুধ পোড়া গন্ধে যে রাজ্য ভুবন ভরে গেল!
.
তারপর সে রাত্রিটা মল্লিকার কেমন করে কাটে কে জানে, কিন্তু পরদিন থেকে ভারী চুপচাপ আর শান্ত হয়ে যায় সে।