সেই কৃতাৰ্থমন্যতা কোথায় গেল? কাজগুলো যান্ত্রিক হয়ে উঠছে কেন?
সংসারী গৃহস্থের মূর্ত প্রতীক প্রভাত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে অসময়ের ফুলকপির জোড়া হাতে ঝুলিয়ে ভাবতে ভাবতে আসে, মাকে বলবে, মা, দুটোই যেন তুমি চিংড়িমাছ দিয়ে বেঁধে শেষ করে দিও না। তোমার নিরিমিষ ঘরে রাঁধবে একটা
মল্লিকার মধ্যেকার সুর কেটে যায়।
প্রভাত কেন এমন জোলো, এমন ক্ষুদ্র সুখে সুখী?
এমনি এক সুরকাটা সন্ধ্যায়, যখন প্রভাতের মা গিয়েছেন পাঠবাড়ীতে পাঠ শুনতে, আর নির্জন বাড়ীর দালানের একেবারে একটেরে ছোট্ট একটা তোলা উনুন জ্বেলে মল্লিকাকে ক্ষীর জ্বাল দিতে হচ্ছে শাশুড়ীর রাতের খাওয়ার জন্যে, খিড়কির দরজায় হুড়কো ঠেলার শব্দ হল।
পাড়াগাঁয়ের প্রথামত হুড়কোটা এমনভাবে ঠেকানো থাকে, যাতে বাইরে থেকেই খুলে বাড়িতে ঢোকা যায়। আর সে পদ্ধতিটা বাড়ির সকলেরই জানা থাকে। প্রভাতও প্রায়শই এই পিছন-দরজা দিয়ে ঢোকে। শব্দটা শুনে মল্লিকা ভাবল তাই হবে–প্রভাতই এসেছে। আর তাকিয়ে দেখল না।
অন্যদিন হলে হয়তো মল্লিকা তাড়াতাড়ি তাকিয়ে দেখত, কিন্তু আজকের সন্ধ্যার সুর কাটা। আজ আর মল্লিকা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে না। বরং আরও ঘোমটা টেনে হেঁটমুখে কড়ায় হাতা নেড়ে নেড়ে দুধ জ্বাল দিতে থাকে। পরণে একখানা লাল হলদে ছাপ মারা সিল্কের শাড়ি আর শাড়ির পাড়ের সঙ্গে মিলোনো একটি লাল সিল্কের ব্লাউস। যদিও সাজটা বাহারী তবে এ একেবারে ভাড়ারঘরের আলনায় রাখা বিশুদ্ধ। ক্ষীর জ্বাল না হওয়া পর্যন্ত এ পরে কাউকে স্পর্শ করার উপায় নেই।
প্রভাত প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় এসে এই দৃশ্যটিই দেখে। মা পাঠবাড়ীতে যান, ঝিটা সারাদিনের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যার মুখে বিদায় নেয়, আর মল্লিকা বিশুদ্ধ শাড়ি পরে শাশুড়ির রাতের খাওয়ার ক্ষীর জ্বাল দেয়।
প্রভাত অনুযোগ করে, কাজটা একটু আগে আগে সেরে রাখতে পারো না? সারাদিনের পর বাড়ি এসে ঝপ করে একটু ছুঁতে পাই না–এ যেন বক্ষে অগাধ তৃষ্ণা, অথচ সামনে লবণ সমুদ্র!
মল্লিকা ভ্রভঙ্গী করে উত্তর দেয়, তৃষ্ণাটা একটু কমাও, বাড়ির যখন এই ব্যবস্থা। গরু দোহা হবে সন্ধ্যার মুখে। আমাদের ওখানে তো বেলা চারটে না বাজতেই কথাটা প্রায়শই শেষ হয় না। যে কোনও সময় অসতর্কে আমাদের ওখানে বলে ফেলেই থেমে যায় মল্লিকা। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, চারটে-পাঁচটার সময় দুধটা দোহা হলে ঠিকই কাজ সেরে রাখতাম।
কিন্তু এসব হচ্ছে যেদিন ভিতরের সুর ঠিক থাকে। তাল ভঙ্গ হয় না। আজ আর ঠিক তেমনটি ছিল না। আজ মল্লিকার ভিতরের সুর গেছে কেটে, তার গেছে ঢিলে হয়ে। আজ তাই খিড়কির হুড়কো ঠেলে যে ব্যক্তি ঢুকল, তার দিকে উদাস একটি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে মল্লিকা নিজের কাজ করে চলে।
কিন্তু বাড়িতে যে ঢুকল সে কি প্রভাত?
.
মল্লিকা ত্রস্ত হল।
তারপর দেখল পরিমল। বছর কুড়ি-বাইশের একটি সুকান্তি ছেলে। ফরসা রং, চুলগুলি উল্টে আঁচড়ানো, পরণে একটা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মুখে মৃদু হাসি।
জেঠিমা বাড়ী নেই? বলল ছেলেটা।
মল্লিকা বৌগিরি বজায় রেখে আস্তে বলে, মা তো রোজই এ সময় পাঠ শুনতে যান।
আর প্রভাতদা?
সেও তো সেই কখন ফেরে।
ছেলেটা দাওয়ার একধারে বসে পড়ে বলে ওঠে, এ ভারী অন্যায় প্রভাতদার। আপনি এই সন্ধ্যাবেলা একা থাকেন, ওর একটু আগে ফেরাই উচিত। পাঁচটায় তো ছুটি হয়ে যায় ওর।
ছেলেটা প্রভাতের খুড়তুতো ভাই, একটু বেশি বাক্যবাগীশ। তবে জেঠিমা অর্থাৎ প্রভাতের মার কড়া দৃষ্টির সামনে সে বাক্যস্রোত রুদ্ধ রাখতে হয়। সেই রেখেই আসছে। আজ এমন নির্জন বাড়ীতে বৌদিকে একা পেয়ে তার বাক্যের ধারা উথলে ওঠে…প্রভাত সম্পর্কে ওই মন্তব্যটুকু সেই উথলে ওঠার সূচনামাত্র। কথাটা নিতান্তই বলার জন্যে বলা।
কিন্তু তুচ্ছ এই কথাটুকুই যেন মল্লিকার সমস্ত স্নায়ু শিরা ধরে নাড়া দিয়ে দেয়। ওর মনে হয়, সত্যিই তো? এ অন্যায়, একান্ত অন্যায়। এই নির্জন সময়টুকু প্রভাত ইচ্ছে করে নষ্ট করে। এ সময় ও যায় বাজার ঘুরে নতুন ফুলকপি কি অসময়ের আম, গঙ্গার ইলিশ কি টাটকা ছানা সওদা করতে।
ছি ছি!
নিশ্চয় প্রভাতের মনের মধ্যে নেই আগ্রহের ব্যাকুলতা। তাই খুড়তুতো দেওরের এই কথায় বিদ্যুৎ-শরাহতের মত উঠে দাঁড়িয়ে সরে এসে বলে, উচিত কাজ তোমাদের এই বাড়িতে কে বা করছে! নইলে তোমাদের দাদার কি উচিত ছিল এই আমাকে বিয়ে করা?
কী মুশকিল! সেটা আবার কী এমন অনুচিত হল? আমরা তো নিত্য প্রভাতদাকে হিংসে না করে জলগ্রহণ করি না।…
ভুল-ভুল, সব ভুল। উচিত হয়নি আমাকে বিয়ে করা। বনের পাখীকে ধরে খাঁচায় এনে পোরা।
ছেলেটা হেসে উঠে বলে, তা সুন্দর পাখীটি দেখলে কেই বা না চেষ্টা করে তাকে ফাঁদ পেতে ধরে ফেলে খাঁচায় পুরতে। সত্যি চাকরী করতে বিদেশে তো সবাই যায়, প্রভাতদার মত এমন অচিন দেশের রাজকুমারীর দেখা কে পায় বলুন?
হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে মল্লিকা। সহসা চকিত করে ভোলা বাঁচাল হাসি। এ হাসি আজও মনে আছে মল্লিকার? আজও পারে এ হাসি হাসতে? এ ওকে চেষ্টা করে করতে হল না? অনেকগুলো মাতালের সম্মিলিত হাসির বিপরীতে? চেষ্টা করে আনা, শেখানো বাঁচাল এই হাসি মল্লিকার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে নাকি?