প্রভাত হাসে। বলে, আমাদের ঠাকুর নয়, তোমার ঠাকুর, সকলের ঠাকুর।
মল্লিকা মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ গো মশাই, তাই।
তবু প্রভাতের মনে হয় মার কাছে যে আন্তরিক অভিনন্দন পেল, মল্লিকার কাছে বুঝি তেমন নয়।
অথচ মল্লিকার জন্যেই তো
কেন? এখানে টাকার অঙ্ক কম বলে? কিন্তু তাই কি হতে পারে? মল্লিকার দিল্লীর ভীতি তো দেখেছে সে!
তবে কেন তেমন খুশী হলো না মল্লিকা?
কিন্তু সত্যিই কি মল্লিকা খুশী হয়নি?
নিজেই সেকথা ভাবছে মল্লিকা।
খুশী খুশী, খুশীতে উপচে পড়া উচিত ছিল তো তার। কিন্তু তেমন হচ্ছে না কেন? কেন হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতাবোধ সমস্ত স্নায়ু-শিরাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে কোথায় বুঝি একটা মস্ত জমার ঘর ছিল তার, সে ঘরটা সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল!
কি সেই জমা? কী সেই ফুরিয়ে যাওয়া?
.
গভীররাত্রে যখন প্রভাত পড়েছে ঘুমিয়ে, আর প্রভাতদের এই পাড়াটা নিঃঝুম নিঃসাড় হয়ে যেন ছায়াদৈত্যের মত ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, তখন মল্লিকা বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়।
জানলার ঠিক নীচেটাতেই খানিকটা ঝোঁপ, তা থেকে কেমন বুনো বুনো গন্ধ আসছে। মল্লিকার মনে হল এ গন্ধ যেন জোলো ভাবপ্রবণতার, সস্তা উচ্ছ্বাসের।
আগে, অনেকদিন আগে এমনি করে মাঝরাতে উঠে জানলার ধারে কি দাঁড়াত না মল্লিকা? . দাঁড়াত বৈকি, দাঁড়াত। কিন্তু সে জানলা খুলতেই এক ঝলক বাতাসের সঙ্গে যে গন্ধ এসে ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে ধাক্কা দিত, সে গন্ধ বনকচু আর আশশ্যাওড়ার নয়। সে গন্ধ যেন অদূরে বিচরণশীল বাঘের গন্ধ। যার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক ভয়ের রোমাঞ্চ, উগ্র এক মদের স্বাদ।
আর উদ্দাম সেই পাহাড়ী ঝড়।
যে ঝড় হঠাৎ কোনও এক রাত্রির বুক চিরে ক্রুদ্ধ-গর্জনে ছুটে আসত কোন দূর-দূরান্তের অরণ্য থেকে। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত গুঁতো মারত পাহাড়ের গায়ে গায়ে। তার সেই উন্মত্ত আক্ষেপের ফেঁ-ফেঁসানিতে উত্তাল হয়ে উঠত দেহের সমস্ত রক্তকণিকা, সমস্ত প্রাণ আছড়ে পড়তে চাইত অজানা কোনও এক ভয়ঙ্করতার মধ্যে।
জীবনে আর কোনও দিন সেই দূর অরণ্যের দুরন্ত ডাক শুনতে পাবে না মল্লিকা? দেখতে পাবে না ঝড়ের সেই মাতামাতি?
আচ্ছা মামা কি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন মল্লিকাকে? দেখতে পেলেই একখানা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেলবেন বলে? যতদূর নয় ততদূর বেইমানী তো করে এসেছে মল্লিকা তার সঙ্গে!
তা বেইমানী বৈকি। তাছাড়া আর কি।
মামা তার জীবনের ভয়ঙ্কর এক রাহু, কিন্তু মামা তার জীবনদাতাও নয় কি? মল্লিকা যে এই মল্লিকা হল, যে মল্লিকা ভাবতে জানে, স্বপ্ন দেখতে জানে, জীবন কি তা বুঝতে জানে সে মল্লিকাকে গড়ল কে?…কোথায় থাকত সেই মল্লিকা, মামা যদি তাকে নিয়ে না যেত?
মামা নিয়ে না গেলে তো তাদের সেই রিষড়ের বাড়ীতে কাকাদের আশ্রয়ে গণ্ডমুখ গাঁইয়া একটা মেয়ে হয়ে পড়ে থাকতে হত মল্লিকাকে, হয়তো কোন্ কালে হতভাগা একটা বরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যেত, হয়তো একপাল ছেলেমেয়েও হত এতদিনে। পাহাড়ী ঝড়ের উন্মত্ত রূপ কোনদিন দেখতে পেত না মল্লিকা, দেখতে পেত না হঠাৎ-বিদ্যুতের মত বাঘের গায়ের হলুদ কালো ডোরা।
তবে মামাকে সে বন্ধু বলবে, না শত্রু বলবে?
হঠাৎ একটা ঝোড়ো ঝোড়ো বাতাস ওঠে, আর সেই বাতাসের শব্দের মধ্যে যেন হা-হা-করা একটা হাসি ভেসে আসে। অনেকগুলো মাতালের সম্মিলিত হাসি।…হাজার মাইল দূর থেকে কেমন করে ভেসে এল এ হাসি!
বুক কেঁপে উঠল মল্লিকার। আর ঠিক সেই সময় বুঝি ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতই পিঠের উপর একখানা স্নেহ-কোমল হাত এসে পড়ল।
প্রভাত ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে।
নরম গলায় বলছে, এমন করে দাঁড়িয়ে আছ কেন মল্লিকা? ঘুম আসছে না?
ফিরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ স্বামীর বুকের ওপর আছড়ে পড়ে মল্লিকা। রুদ্ধ গলায় বলে, তুমি কেন ঘুমিয়ে পড়? তুমি কেন আমার সঙ্গে জেগে থাক না?
সহজ স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয় প্রভাত–এ হচ্ছে মল্লিকার অভিমান। সত্যি মল্লিকা যখন জেগে বসে আছে, তখন এমন অচৈতন্য হয়ে ঘুমনো উচিত হয়নি প্রভাতের। তাই ওকে কাছে টেনে নেয়, আরও নরম গলায় বলে, সত্যি মল্লিকা, আমি একটা বুন্ধু।
এমন স্বীকারোক্তির পর পরিস্থিতি নিতান্ত সহজ হর যেতে দেরি হয় না, কিন্তু সেই সহজ সুর কি স্থায়ী হয়? মাঝে মাঝেই কেটে যায় সে সুর মাঝে মাঝেই বিস্বাদ হয়ে ওঠে মল্লিকার, এই ছকে বাঁধা সংসারের সুনিপুণ ছন্দ।
কিন্তু ঘরকুনো প্রভাত বড় খুশীতে আছে। হাওড়া থেকে বালি, অফিস থেকে বাড়ী। খাবার ঘর থেকে শোবার ঘর, মার স্নেহচ্ছায়া থেকে স্ত্রীর অঞ্চলছায়া।
তাঁতির মাকুকে এর বেশি আর ছুটোছুটি করতে হয় না। আবাল্যের পরিবেশ মনকে সর্বদা সুধারসে সিক্ত করে রাখে, মাঝখানের বিদেশবাসের তিনটে বছর ছায়ার মত বিলীন হয়ে যায়।
এতদিনে বুঝি প্রভাত জীবনের মানে খুঁজে পায়।
কিন্তু মল্লিকা ক্রমশ জীবনের মানে হারাচ্ছে কেন? কেন ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে? স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে? হয়তো বা মাঝে মাঝে একটু রুক্ষও!
এতদিন ভোর থেকে সুরু করে রাত্রি পর্যন্ত গৃহস্থালীর কাজগুলির ভার পেয়ে যে সে প্রতিমুহূর্তে কৃতার্থ হয়েছে, বিগলিত হয়েছে তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে, লক্ষ্মীর ঘরে ধূপধুনো দিতে, পূর্ণিমায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের জন্যে মালা গাঁথতে, চন্দন ঘষতে!