কিন্তু বিদায়ই বা কেন? কোয়ার্টার্স তো পাওয়া যাচ্ছে।
এখনো ভাইপোর জন্য কাকার দরদের পরিচয়ে কাকিমা বিরূপ, কিন্তু কাকা নিজ নীতিতে অটল আছেন।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে মাকে দেখায় প্রভাত। মা বলেন, তা বটে! কিন্তু আমার যে অভ্যেস খারাপ করে দিলি বাবা! বৌমাটিকে ছেড়ে
প্রভাত বলে, উঃ মা! নিজের ছেলেটিকে ছেড়ে এতদিন থাকতে পারলে
মা হাসেন। বলেন, কী করব। মেয়েটা বড় মায়াবিনী!
মায়াবিনী শব্দের নতুন অর্থে হাসে প্রভাত। আর মল্লিকাকে গিয়ে ক্ষ্যাপায়, ওগো মায়াবিনী, কি মায়া জানো?
মল্লিকার চোখে কিন্তু শঙ্কা ঘনায়।
.
দিল্লী!
দিল্লী যে বাঘের গুহার তল্লাটে! মামাকে মাঝেমাঝেই আসতে হয় দিল্লীতে-মামার বেশির ভাগ খদ্দের আসে দিল্লী থেকে!
প্রভাত বলে, দিল্লী কত বড় শহর, কত তার লোকসংখ্যা! কে সন্ধান রাখবে, কোন কোয়ার্টার্সে সেই মিসেস ব্যানার্জি বাস করেন, যার পুরনো নাম ছিল মল্লিকা!
না গো, আমার ভয় করছে।
তবে চাকরীবাকরী ছেড়েই দেওয়া যাক, কি বলো?
তাই দাও না গো! মল্লিকা লুটিয়ে পড়ে, কলকাতায় একটা চাকরী জোগাড় করে নিতে পারবে না?
হয়তো পারি। কিন্তু লোকের কাছে পাগল নাম কিনতে চাই না, বুঝলে? কেন ভয় পাচ্ছ?
কিন্তু ভয়! ভয়! ভয় যে মল্লিকার স্নায়ুতে শিরাতে পরিব্যাপ্ত! কি করে তার হাত এড়াবে সে? কেউ যদি দেখতে পায়? যদি সে গিয়ে মামাকে খবর দেয়? যে মামা দেখতে নিতান্ত নিরীহ হলেও বাঘের মতই ভয়ঙ্কর। কে বলতে পারে অসতর্ক প্রভাতের তাজা রক্তে একদিন দিল্লীর রাস্তা ভিজে উঠবে কি না।
তাই শেষ পর্যন্ত মল্লিকার ভয়ই জয়ী হয়।
লোকের কাছে পাগল নামই কিনে বসে প্রভাত।
কাকাকে লিখে পাঠায়, বাংলার বাইরের রুক্ষ জলবায়ু তার ঠিকমত সহ্য হয়নি। এখন তো আরও হবে না, কারণ শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। নচেৎ কেন এতবার মেডিক্যাল লিভ নিতে বাধ্য হচ্ছিল?
অতএব?
পৌনে পাঁচশ টাকার চাকরী? তা কি আর করা যাবে?
প্রভাতের দুই দাদা, যাঁরা বাড়ীর মধ্যেই আড়াল তুলে মায়ের সঙ্গে পৃথকান্ন হয়ে বাস করছেন, তাঁরা ছি ছি করেন, এবং পুরাণ উপপুরাণ থেকে সুরু করে আধুনিক ইতিহাস পর্যন্ত স্ত্রীর বশ পুরুষের কী কী অধোগতি হয়েছে তার নজীর দেখান।
কাকা চিঠির মারফতই সম্পর্ক ছেদ করেন, এবং পাড়া-প্রতিবেশী গালে হাত দেয়।
দিল্লী নামক ইন্দ্রপুরীর স্বর্গীয় চাকরী যে কেউ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেয়, এ লোকের ধারণার বাইরে।
শুধু করুণাময়ী!
করুণাময়ী ছোট ছেলের এই সুমতিতে পাঠবাড়ীতে হরিলুট দিয়ে আসেন।
ধারেকাছে দুই ছেলে বৌ, কিন্তু করুণাময়ী থাকতেন বেচারীর মত। নিঃসহায় নিরভিভাবক। অথচ তেজ আছে ষোল-আনা, তাই পৃথকান্ন ছেলেদের সাহায্য নিতেন না। অসময়ে দরকার পড়লে বরং পাড়ার লোকের কাছে জানাতেন তো ছেলেদের নয়।
শাশুড়ীর এই অহঙ্কারে ছেলের বৌরাও ডেকে কথা কইত না।
প্রভাত এসে পর্যন্ত করুণাময়ী একটা সহায় পেয়েছেন। তাছাড়া ছোটবৌয়ের রূপগুণ! যেটা বড় মেজ বৌকে থ করে দেবার মত! করুণাময়ীও একটা রাজত্বের অধীশ্বরী হয়েছিলেন এই কমাস।
তবু মনের মধ্যে বাজছিল বিদায়রাগিণী। ফুরিয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে এই আবুহোসেনের রাজ্যপাট! ফুরিয়ে যাবে সংসার করা!
ছুটি ফুরোলেই বৌ নিয়ে লম্বা দেবে প্রভাত, আর আবার দুই বৌয়ের দাপটের মাঝখানে পড়ে করুণাময়ীকে শুধু হরিনামের মালা সম্বল করে মানমর্যাদা বজায় রাখতে হবে।
বেশ করেছে প্রভাত দূরের চাকরী ছেড়ে দিয়ে। তেমন চেষ্টা করলে কি আর কলকাতায় একটা চাকরী জুটবে না?
তা মাতৃআশীর্বাদের জোরেই হোক আর চেষ্টার জোরেই হোক কলকাতায় চাকরী জোগাড় হয়।
প্রভাত এসে মাকে প্রণাম করে বলে, মাইনে অবিশ্যি এখানে ও চাকরীর থেকে কম, কিন্তু ভবিষ্যৎ খারাপ নয়।
করুণাময়ী আশীর্বাদের সঙ্গে অশ্রুজল মিশিয়ে বলেন, তা হোক। তা হোক। ঘরের ছেলে ঘরের ভাত খাবি, কী বা খরচ! আমি বলছি এই চাকরীতেই তোর উন্নতি হবে।
তা হলে খুশী?
হ্যাঁ বাবা, খুব খুশী।
ঘরে গিয়ে মল্লিকাকেও সেই প্রশ্ন করতে যায়। কিন্তু ঘরে পায় না মল্লিকাকে।
কোথায় সে? রান্নাঘরে? ভাড়ারঘরে? ঠাকুরঘরে? গোহালে?
না।
ছাদে উঠেছে মল্লিকা।
প্রভাত এসে আলশের ধারে বসে পড়ে। বলে, উঃ খুব খাটালে! এই চূড়োয় উঠে বসে আছ যে?
খুঁজবে বলে। মল্লিকা হাসে।
কিন্তু হাসিটা কেমন নিষ্প্রভ দেখায়।
আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আজ আমার জন্যে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে!
ইস! সেইরকম বাড়ি কিনা তোমাদের!
আহা, বাড়ি মানে তো বড়বৌদি মেজবৌদি! ওঁদের নিয়ে কিছু এসে যায় না। যাক, খুশী তো?
খুশী।
মল্লিকা অমন চমকে ওঠে কেন? কেন বলে, কিসের খুশী?
বাঃ চমৎকার! দিল্লীর সঙ্গে সম্পর্কছেদের পাকা বনেদ গাঁথা হল না? ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রির কাজটা পেয়ে গেলাম না আজ!
ওমা তাই বুঝি! সত্যি হল? মল্লিকা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রভাতের হঠাৎ মনে হয় মল্লিকার এই উচ্ছ্বাসটা যেন রঙ্গমঞ্চের অপটু অভিনেত্রীর শেখা ভঙ্গির মত।
ভুরু কুঁচকে বলল, কই, খুব খুশী তত মনে হচ্ছে না!
মল্লিকা জোর হেসে উঠল, কী যে বলল। আমি বলে তোমাদের ঠাকুরের কাছে পূজো মেনেছিলাম, যাতে তোমার আগের চাকরীটা ঘোচে, এখান থেকে আর কোথাও যেতে না হয়!