পুষ্প আর পুস্পসারের সম্মিলিত তীব্র মধুর গন্ধে উতলা হয়ে উঠল বাতাস, আর পরিহাস রসিকার দল বিদায় নেওয়ার পরেও যেন ঘরের মধ্যে উত্তাল হয়ে রইল তাদের পরিহাসের উদ্দামতা।
আমার জন্যে কত জ্বালা তোমার!
মল্লিকা গভীর কালো চোখ দুটি তুলে তাকায়।
প্রভাত সেই গভীর দৃষ্টির ছায়াকে নিবিড় করে তুলে আবেগকাঁপা গলায় বলে, হ্যাঁ ভারী জ্বালা! অনেক জ্বালা!
না সত্যি। কে জানে কেন কুগ্রহের মত হঠাৎ এসে পড়লাম তোমার জীবনের মধ্যে
বোধকরি কোন সুগ্রহের আশীর্বাদে
চিরদিন কি এ স্নেহ রাখতে পারবে তুমি আমার ওপর?
সন্দেহ কেন মল্লিকা?
না গো না, ভুল বুঝো না তুমি আমায়! সন্দেহ নয় ভয়?
ওটা বড্ড সেকেলে, বড় পুরোনো। শরৎবাবুর উপন্যাসের নায়িকার উক্তির মত।
মল্লিকা আবার সেই গভীর চোখ দুটি তুলে তাকায়। মল্লিকাকে আর রূপসী বলে মনে হয় না, মনে হয় লাবণ্যময়ী। রমণীয় নয়, কমনীয়। বিদ্যুৎ নয়, গৃহদীপ।
সেই আরতির দীপের মত দৃষ্টিটি তুলে মল্লিকা বলে, তা ভাগ্য যাকে সেকেলে উপন্যাসের নায়িকা করে তুলেছে
তা বেশ তো। সেকেলে উপন্যাসের কেন, হেসে ওঠে প্রভাত, আধুনিক উপন্যাসের নায়িকা হও। যারা প্রতি পদে ভয় পায় না, প্রতি পদে নিজেকে ছোট বলে মনে করে না। সাহসিকা তেজস্বিনী
ঘনিষ্ঠ করে কাছে টেনে নেয় প্রভাত আইন এবং অনুষ্ঠান উভয় শক্তিতে লাভ করা সদ্যলব্ধাকে।
মল্লিকা ভেঙে পড়ে।
অস্ফুট স্বরে বলে, না না, ওসব কিছু হতে চাই না আমি। আমি শুধু বৌ হতে চাই। বাংলার গ্রামের বৌ। যে বৌয়ের ছবি দেখেছি জীবনের শৈশবে। যারা পবিত্র সুন্দর মহৎ।
নাঃ, বড্ড বেশি সিরিয়াস হয়ে উঠছ। মনে রেখো এটা আমাদের ফুলশয্যার রাত্রি।
পরিবেশ হালকা করে তুলতে চায় প্রভাত। জীবনের এই পরম রাত্রিটিকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে চায় না কতকগুলো ভারী ভারী কথায়। বিয়েটাকে একেবারে সাধারণ বিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেই বা ক্ষতি কি?
এ বিয়েতে কাকিমা অবশ্য আসেন নি। খবর পেয়ে নিজের গালেমুখে চড়িয়েছেন, আরও আগে কেন গেঁথে ফেলেন নি বলে। আর শেষ আক্ষেপের কামড় দিয়েছেন বড়জার কাছে চিঠিতে, তাঁর বোন ভগ্নিপতি কী পরিমাণ দানসামগ্রী, আর কী পরিমাণ নগদ গহনা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তার হিসেব দাখিল করে।
করুণাময়ী একবার কপালে করাঘাত করেন, আবার একবার ভাবেন, মরুক গে! সে হলে ছেলেটা তো আমার স্রেফ ছোট গিন্নীর সম্পত্তি হয়ে যেত!
প্রভাত হাসে। মল্লিকার কাছে। বলে, উঃ, ভাগ্যিস ওই দানসামগ্রী আর নগদের কবলে পড়ে যাইনি!
.
ওদের হাওড়ার বাড়ীতে এখনও গ্রাম-গ্রাম গন্ধ। ঘরে গৃহদেবতা, উঠোনে তুলসীমঞ্চ, রান্নাঘরে শুচিতার কড়া আইন।
তাছাড়া গোহালে আছে গরু, পুকুরে আছে মাছ।
মল্লিকা বিভোর হয়, বিগলিত হয়। এই তো ছিল স্বপ্ন! ভাবে, ভগবান, আমার জন্যে এত রেখেছিলে তুমি!
প্রথম প্রথম সর্বদা একটা অশুচিতাবোধ তাকে সব কিছুতে বাধা দিত। শাশুড়ি ডাকতেন, বৌমা, আজ লক্ষ্মীপূজো, ঘরে-দোরে একটু আলপনা দিতে হয়–পারবে তো? মেলেচ্ছ দেশে মানুষ, দেখনি তো এ সব। যাক, যা পারো দাও।
মল্লিকা ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। কিন্তু পারাটা তার নেহাৎ যেমন তেমন হয় না। মনের জগতে ভেসে ওঠে শৈশবে-দেখা মায়ের হাতের কাজ। এ বাড়ী ও-বাড়ী থেকে আলপনা দিতে ডাকত মল্লিকার মাকে, ডাকসাইটে কর্মিষ্ঠে ছিলেন তিনি।
শাশুড়ি প্রীত হন। ভাবেননাঃ, যেমন ভেবেছিলেন তেমন নয়। সদ ব্রাহ্মণের আচার জানে! ডাকেন, বৌমা, একখানা সিল্কের শাড়িটাড়ি কিছু জড়িয়ে আমার ঠাকুরঘরে একবার এসো তো। চন্দন ঘষে, ফুলকটায় একটু মালা গেঁথে দেবে।
মল্লিকা কম্পিত চিত্তে ভাবে, এই মুহূর্তে ভয়ানক একটা কিছু হয় না তার! হঠাৎ পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কি ওইরকম কিছু?
শাশুড়ী ডাকেন, কই গো বৌমা
ছুটে যাওয়া ভিন্ন গতি থাকে না।
ক্রমশ ভয় ভাঙে। নিজেই এগিয়ে যায়। কিন্তু রাত্রে কাতরতায় ভেঙে পড়ে। বলে, আমার এতে পাপ হচ্ছে না?
প্রভাত আদরে ডুবিয়ে দেয়। বলে, কী আশ্চর্য! পুণ্যি না হয়ে পাপ হবে? এসব তো পুণ্যকর্ম, বরং যদি কিছু পাপ থেকে থাকে, ধুয়ে মুছে যাবে। কিন্তু এখনো এত কাতর কেন তুমি মল্লিকা? আমি তো তোমায় বলেছি, স্বেচ্ছায় অন্যায় না করলে পাপ স্পর্শ করে না।
ধীরে ধীরে বুঝি কেটে যায় সমস্ত গ্লানি! নতুন আর-এক জন্মে জন্ম নেয় মল্লিকা! মন বদলেছে, দেহটাও বুঝি বদলাচ্ছে।
নখের আগায় নেলপালিশের বদলে হলুদের ছোপ, ঠোঁটে লিপস্টিকের বদলে পানের রাঙা, সুর্মাবিহীন চোখ ন কোমল। শাড়ী পরার ভঙ্গিমা বদলে ফেলেছে মল্লিকা, বদলেছে জামার গড়ন।
মল্লিকা আস্তে আস্তে তার মার মত হয়ে যাচ্ছে। পুণ্যবতী সতীমায়ের মত। যে মা তার খেটে খেয়েছে, কিন্তু সম্মান হারায়নি।
.
কিন্তু অনাবিল সুখ মানুষের জীবনে কতক্ষণ? প্রভাতের কাকার চিঠি আসে, বিয়ে তো আমরাও একদা করেছিলাম বাপু, কিন্তু এভাবে উচ্ছন্ন যাইনি। আর বেশি ছুটি নিলে চাকরীতেই ছুটি হয়ে যাবে। শীঘ্র চলে এসো। এবার একেবারে খোদ রাজধানী! তাছাড়া কোয়ার্টার্স পাওয়া যাবে।
অর্থাৎ নানা টালবাহানা করে করে মেডিক্যাল লিভ নিয়ে নিয়ে যে বিভোর গৃহসুখের জগতে বাস করছিল প্রভাত, তার থেকে বিদায় নিতে হবে।