করুণাময়ী ঝঙ্কার দেন, এই কদিন বিদেশ ঘুরে এসে অনেক কথা শিখেছিস দেখছি। এ আর কিছু নয় তোর খুড়ির কুশিক্ষা। চিরদিন দেখেছি ছোটবো তোকে বেশি ভালবাসার ভান করে আমার বিপক্ষে উস্কেছে। আর এবার তো একেবারে বেওয়ারিশ হাতে পেয়েছিস!
আহা কী মুশকিল! সে ভদ্রমহিলাকে আবার এর মধ্যে টানছ কেন? যার কথা হচ্ছিল তার কথাই হোক না। ওই মামা নামক ভদ্রলোকটির পদবী চ্যাটার্জি এতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘকালের ব্যবসা-বাণিজ্য সেখানে তার। জীবনের প্রারম্ভে কি আর ভদ্রলোক ভবিষ্যৎ দর্শন করে রেখেছিলেন যে, সুদূর কালে তিনি ভাগ্নীদায়ে পড়বেন, আর এই আমা হেন গুণনিধি তার কবলে গিয়ে পড়বে, তাই সেই আগে থেকে গলায় পৈতে ঝুলিয়ে চাটুজ্যের খাতায় নাম লিখিয়ে বসে থেকে ছিলেন?
হয়েছে, অনেক কথা শিখেছিস। যাক তবুও হেস্তনেস্ত আমি দেখব। ওই রিষড়ে না কোথায় যেন মেয়ের বাপের দেশ বলছিস, সেখানে খোঁজ করাব আমি–তবে বৌ বরণ করে ঘরে তুলব।
প্রভাত চুপ করে ছিল। চট করে মুখের ওপর বলতে পারে নি রিষড়েই হোক আর রাজস্থানই হোক, যতই তুমি তোলপাড় করে ফেলো মা, বিয়ে ওকে আমি করবই। আমাকে করতে হবেই। আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি, আশ্বাস দিয়েছি।
ভেবেছিল দেখাই যাক না মায়ের দৌড়! কে যাবে অত খোঁজখবর নিতে।
মল্লিকা তখন অবস্থান করছে প্রভাতের এক ছেলেবেলার বন্ধুর বোনের বাড়ীতে। করুণাময়ীই। এ ব্যবস্থার ব্যবস্থাপক।
বলেছিলেন, বাড়ীতে এনে ভরে রেখে তারপর বৌ করে বরণ করা সে যে একেবারে পুতুলের বিয়ের বেহদ্দ! ওর থাকার ব্যবস্থা আমি করছি। যা দেখছি, বিয়ে তুমি ওকে করবেই, তবু লোক-সৌষ্ঠবটা তো রাখতে হবে!
হ্যাঁ, প্রথমটা এমনি কঠিনই হয়েছিলেন করুণাময়ী। কিন্তু মল্লিকার নম্রতা, মল্লিকার দুঃখগাথা আর মল্লিকার রূপ, এই তিন অস্ত্রে ক্রমশ কাবু হয়ে পড়েছিলেন।
তা মেয়েরাই কি মেয়েদের রূপে মুগ্ধ হয় না? হয় বৈকি। রূপকে হৃদয়ের নৈবেদ্য না দিয়ে . উপায় কোথায় মানুষের? প্রকৃতিই যে তাকে এই দুর্বলতার কাছে মেরে রেখেছে।
তবু তল্লাস করতে ছাড়লেন না।
রীতিমত তোড়জোড় করেই তল্লাস করলেন, রিষড়েয় আঠারো বিশ বছর আগে সুরেশ মুখুজ্যে বলে কেউ ছিল কিনা।
যে লোককে পাঠিয়েছিলেন, সে এসে বিস্তারিত বলল, হ্যাঁ, ছিল বৈ কি, ছিল। সেই সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতিরা তো রয়েছে এখনো রিষড়েয়।
সুরেশ মুখুজ্যে মরেছে অনেকদিন, তার স্ত্রী কন্যা ছিল। মেয়েটাকে নিয়ে দুঃখুকষ্ট করে চালাচ্ছিল ও, কিন্তু সুরেশের স্ত্রীও মরল। আর সেই খবর পেয়ে তার ভাই, অর্থাৎ ওই আপনাদের মেয়ের মামা মাদ্রাজ না পাঞ্জাব কোথা থেকে এসে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল। তারপর কে কার খবর রাখে! অবিশ্যি একথা বলতে ছাড়েন নি সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতিভ্রাতা, মেয়েটাকে আমার কাছে রাখবার জন্যে ঢের চেষ্টা করেছিলাম মশাই, বলি ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক, বিশ্ব বাংলা ছেড়ে কোথায় যাবে? দেখেশুনে বে-থা আমরাই দেব। কিন্তু মামাটি মশাই রগচটা। বলল, না না, ও আমার কাছেই থাকবে ভালো। বলি–তবে তাই হোক। ভালো থাকলেই ভালো। তারপর মশাই কে আর খবর রাখছে?
ভদ্রলোকের কথার বাঁধুনি দেখে অবশ্য বোঝবার উপায় ছিল না তার সেই মহানুভবতার গল্পটি গল্পই মাত্র।
করুণাময়ীর প্রেরিত লোক এসে সেই কথাই বলে, বংশ ভাল বলেই মনে হল। কাকাটি অতি ভদ্র। পাজী ছিল ওই মামাটা। নিজে তো চিরকেলে বাউণ্ডুলে, বাপ মিনসে মেয়ে জামাইকে কাছে নিয়ে রেখেছিল, তা সেই বাপ মরতে নাকি গরীব বোন ভগ্নিপতিকে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে বেচে কিনে চলে গিয়েছিল। কাকা তাই বলছিল–বৌ মরেছে? হাড়ির হাল হয়েছে? বেশ হয়েছে, হবেই তো! অমন লোকের দুর্দশা হবে না তো কার হবে? পাজী লোকের পয়সা কখনো থাকে না।
তা না থাক, করুণাময়ীর শান্তিটা থাকল। তার কোঁচকানো ভুরু কিছুটা সোজা হল। বৌ বরণ করে ঘরে তুললেন তিনি।
কিন্তু করুণাময়ীর পতিকুলেই কি জ্ঞাতি নেই? না তাদের ভুরু নেই?
এ যুগে যে সমাজ নামক শব্দটার কোনও অর্থ নেই এ তারা জানলেও, এবং নিজেরা সমাজকে সম্যকরূপে না মানলেও, এ বিয়ের যজ্ঞিতে খাওয়া-দাওয়ার অনিচ্ছে প্রকাশ করতে ছাড়েননি তারা। আর একথাও বলেছিলেন, ওই একটা অজ্ঞাতকুলশীল মেয়েকে প্রভাতের হঠাৎ ঘাড়ে করে নিয়ে এসে বিয়ে করতে বসা দেখে তারা এত বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন যে, হয়তো করুণাময়ীর সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক ছেদ করতে হবে তাদের।
করুণাময়ী নিজের সেই জ্ঞাতিদের রিষড়ের সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতির ঠিকানা দিলেন। বললেন, খোঁজ করে এস।
খোঁজ?
এমন পাগল আবার কে আছে যে গাঁটের কড়ি খরচা করে তথ্যানুসন্ধানে যাবে? হাওড়া থেকে রিষড়ে গোটাকতক পয়সার মামলা? তাতে কি? তাই বা কেন? জ্ঞাতিদের সঙ্গে সম্পর্ক চোকালেই যখন সব চুকে যায়।
শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি সম্বন্ধ চুকল না। আর ভোজবাড়ীতে চর্বচোষ্য লেহ্যপেয়র স্বাদ নিতেও কার্পণ্য করলেন না তারা, তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। মোটকথা পাত্র-পাত্রী দুপক্ষের মধ্যে
লাখ কথা না হলেও, সেই লাখ কথাটা এক পক্ষেই হল।
তবু শেষ অবধি সবই হল। বিয়ে নামক অনুষ্ঠানটির যে মোহময় এবং ভাবময় ছবিখানি আঁকা ছিল বর আর কন্যার হৃদয়পটে, সে ছবি মলিন হল না। সেই গায়েহলুদ আর ছাঁদনাতলা, কুশণ্ডিকা আর কড়ি খেলা, এয়োদের হুড়োহুড়ি আর তরুণীদের বাড়াবাড়ি ইত্যাদি সপ্তসমুদ্র পার হয়ে অবশেষে ফুলশয্যার ঘাটে তরী ভিড়ল।